আরিফ মোল্ল্যা,ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করার ফলে পৌর শহর এলাকাসহ পুরো এলাকা এখন বিশৃঙ্খল শহরে পরিণত হয়েছে।
উপজেলার কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কের ছালাভরা থেকে শুরু করে বারবাজার ফুলবাড়ি পর্যন্ত মহাসড়কের পাশে যন্ত্রতন্ত্র ভাবে বিভিন্ন যানবাহন পার্কিং এবং নসিমন, করিমন, আলমসাধূ ও লাটা হাম্বারের ষ্ট্যান্ড করার কারণে মানুষের চলাচলে অতিমাত্রাই বেড়েছে জনদূভোর্গা।
তাছাড়া ঝিনাইদহ থেকে শুরু করে যশোর পর্যন্ত এই মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নত করার জন্য সড়কের দু’পাশের শতবর্ষী রেইনট্রি গাছগুলি কর্তন করে বড় বড় গাছেরগুড়িগুলো দীর্ঘদিন ধরে সড়কের পাশে ফেলে রাখা এবং মাটি খুড়ে গাছগুলো কর্তন করায় এই মহসড়কে দু’পাশে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। যার কারণে প্রতি নিয়তে ঘটছে ছোট বড় দূর্ঘটনা। সড়কের ফুটপাত দখল, যত্রতত্র গাড়ির স্ট্যান্ড, অটোরিকশা ও ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য, ভাঙ্গাচূরা রাস্তায় চলাচলের যন্ত্রণা, ধুলাবালি, নিত্যদিনের যানজট ও নানাবিদ সমস্যায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এই এলাকার সাধারণ মানুষ। সচেতন নাগরিক সমাজের অভিমত, কালীগঞ্জের সর্বত্রই জনভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে।
আনুমানিক বছরখানেক আগে কালীগঞ্জ পৌরসভার পক্ষ থেকে শহরের মেইন বাসষ্ট্যান্ড থেকে শুরু করে চিত্রা নদীর নতুন ব্রীজ পার হয়ে পুরাতন বাজার পর্যন্ত সরু রাস্তাটি জনসাধারণের দূর্ভোগ লাঘবের জন্য সম্প্রসারাণ ও রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার নির্মাণ করা হয়। এবং রাস্তার উত্তরের পাশে টাইলস দিয়ে দর্শনীয় ফুটপাত তৈরী করা হয়। তখন থেকেই চৌকি পেতে ফুটপাত দখল করে দোকান বসিয়েছে ভ্রামানমাণ ব্যবসায়ীরা। সম্প্রসারণ করা রাস্তাটি তিন স্তরে দোকান দিয়ে দখল করেছে ফুটপাতের ব্যবসাযীরা এবং দুই স্তর দখল করেছে রিক্সা-ভ্যান ও ইজিবাইকের চালকরা। মোট কথা এই রাস্তার উত্তরের পাশে ২৫ ফুট রাস্তার ২০ ফুটই অবৈধ ভাবে দখল করেছে ফুটপাতের ব্যবসায়ী এবং রিক্সা, ভ্যান, ইজিবাইক, লাটা হাম্বার, আলমসাধূ, ও নসিমন করিমন চালকরা। বাকী ৫ ফুট রাস্তা দিয়ে চরম ঝুকি নিয়ে চলাচল করেন সাধারণ মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের মেইন বাসষ্ট্যান্ড থেকে পুরাতন বাজারে যেতে ফুটপাতে রঙ বেরঙয়ের ছাতা টানিয়ে চলছে নানা ধরনের ব্যবসা। উপর থেকে দেখলে মনে হবে কোন সমুদ্র সৈকতের দৃশ্য। এছাড়া শহরের প্রত্যেকটা ফুটপাতে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ হকারদের জুতার দোকানসহ ভ্যান, রিক্সা, ভ্যান ও ইজিবাইকের যন্ত্রতন্ত্র পার্কিং। হকার দোকানিরা বলছে আমাদের থেকে দিন প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা করে নেয়া হয়। হাটের দিনে দেয়া হয় আরো অতিরিক্ত। তবে বর্তমানে এই টাকা কারা নেয় তাদের নাম জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
পথচারীদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ফুটপাত দিয়ে মানুষের হাঁটার কোনো পরিবেশ নেই। ফুটপাত এখন দখলদারদের দখলে। পথচারীদের হাঁটার কোনো সুযোগ নেই। আর এসব ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ পথচারীই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে যানজটেরও সৃষ্টি হয় প্রতিনিয়ত।
ফুটপাতের ফার্নিচার দোকানের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মালিক যেভাবে নির্দেশ দেয় সেভাবেই আমাদের ব্যবসা করতে হয়। এভাবে রাস্তার উপর ফার্নিচার রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোথায় যাবো, ব্যবসা করতে হলে এখানে ছাড়া আমাদের অন্য কোন জায়গা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা যারা লাখ লাখ টাকা অগ্রিম এবং হাজার হাজার টাকা দোকান ভাড়া নিয়ে যে ব্যবসা করি, ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কারণে বাইরে থেকে আনা পণ্যগুলোর গাড়ি আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে লাগাতে পারি না। তাছাড়া আমরা যে ব্যবস্যা করি সেই একই ধরনের নি¤œ মানের মাল বিক্রয় করছে এই সব ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের সাথে আমাদের প্রতিনিয়ত বিবাদ লেগেই থাকে এবং আমরা ব্যবসায় অর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। যেখানে ফুটপাত দেয়া হয়েছে মানুষের হয়রানি লাঘবের জন্য, সেখানে ফুটপাতেই মানুষকে বেশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কর্মকান্ড দেখেও না দেখার ভান করে। আমরা পৌর কর্তৃপক্ষ এবং উপজেলা প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি যে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের আলাদা ব্যবস্থা করা হোক।
শহরের মেইন বাসষ্ট্যান্ড থেকে বড় বাজার হয়ে নলডাঙ্গা রোড, হাট চাঁদনীর কোন থেকে হাসপাতাল রোডের কোলা-কালা রোড এবং কালীবাড়ির সামেেন থেকে বাজার নিমতলা হয়ে থানার সামনে থেকে নিমতলা বাসষ্ট্যান্ড, গান্না রোড, মুরগী হাটা থেকে কাচামাল হাটা পর্যন্ত সড়কটি এখন চলাচলে প্রতিদিন চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মানুষ। অথচ এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয় উপজেলার একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তাছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার ও ফার্মেসী। দীর্ঘদিন ধরে চলমান অব্যবস্থাপনার মাঝেই মানুষ নানাবিদ ভোগান্তি নিয়েই বসবাস করছেন কালীগঞ্জ উপজেলার সাধারণ মানুষ। এ সব বিষয়ে কালীগঞ্জ পৌর পরিষদ বা উপজেলা প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে।
চলতি বছরের আগস্ট মাসে হঠাৎ করে পৌর পরিষদ থেকে ২০/২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ফুটপাত দখল করে ব্যবসায়ীদের ফুটপাত এবং রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ২৪ ঘন্টার মৌখিক নির্দেশনা দিতে দেন। ওই সময় ফুটপাতের এসব ব্যবসায়িরা একত্র হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে তার কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলেন। সেখানে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা পরিচালনাকারীরা ১৫ দিনের মধ্যে পৌর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে তাদেরকে স্থানান্তরিত করলে তারা ফুটপাত ছেড়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। তার পর থেকে দীর্ঘ কয়েকমাস পার হলেও পৌর কর্তৃপক্ষের উদাসিনতায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
রাস্তার উপর ভ্যানে করে দোকান দেওয়া ডাব বিক্রেতা মোক্তার হোসেন বলেন, এর আগে আমরা ইউএনও স্যারের সাথে কথা বললে ইএনও স্যার পৌর কর্তৃপক্ষকে একটা নির্ধারীত স্থানে আমাদেরকে স্থান্তারিত করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু পৌরসভা থেকে আমাদেরকে কিছু জানায়নি। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের অন্যত্র বসার জায়গা না করে যদি উচ্ছেদ করা হয় তাহলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরবো।
এ ব্যাপারে জানতে কালীগঞ্জ পৌরসভার সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা হকারদের হঠাৎ করে উচ্ছেদ করতে পারি না। তাদের আগে স্থানান্তরের জায়গা নির্ধারণ করে তারপর তাদের স্থানান্তর করতে হবে। কয়েকমাস আগে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের আমরা মৌখিক ভাবে নির্দেশনা দিলে তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট গিয়েছিল। তিনি আমাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন হকারদের জন্য একটা জায়গা নির্ধারন করতে। তারই আলোকে আমরা নতুন বাজারের শেখ রাসেল মিনি ষ্টেডিয়ামের দক্ষিন পাশে জায়গা নির্ধারন করেছি। হকারস মার্কেটের নকশা করা হয়ে গেছে খুব শিঘ্রই টেন্ডার হবে। আশা করি ৩/৪ মাসের মধ্যেই এই ফুটপাত দখলমুক্ত এবং শহরের যানজট নিরসন হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম বলেন, শহরের জানজট নিরসনে করার ব্যাপারে আমাদের পৌর পরিষদের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা হয়েছে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করি খুব দ্রুত ফুট দখলমুক্ত করে জনসাধারণের ভোগান্তি লাঘোব হবে। পাশাপাশি সড়ক মহসড়কে মানুষ যাতে নিবিঘেœ নিরাপদে চলাচল করতে পারে সে বিষয়টিও নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।