মোঃ এমদাদ উল্যাহ,পিবিএ: সিগারেট, বিড়িসহ সব ধরনের তামাক থেকে বিপদের কথা জেনে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩১ মে পৃথিবী জুড়ে তামাক বিরোধী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন থেকেই বিশ্ব জুড়ে ধূমপান ও তামাকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা প্রচার শুরু হয়। কিন্তু তাও বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ তামাকে আসক্ত। আসলে অন্যান্য দেশের তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে অনেক সচেতন। কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখনও সিগারেটের প্রেমে মগ্ন। তামাককে জীবন থেকে বিদায় না করতে পারলে হার্টের নানা অসুখ আর ক্যান্সারের সমস্যায় আজীবন ধুঁকতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাক্যু কন্ট্রোল-এর ১১ নং আর্টিকেল অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক সিগারেটের প্যাকেট এবং তামাকের বিভিন্ন মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য বাণী ছাপানোর বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আছে। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে প্রথম দেশ, যেখানে ডিসেম্বর ২০১২ হতে সচিত্র সতর্কবাণী পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে। সচিত্র সতর্কবাণী হচ্ছে; তামাকের ক্ষতি সম্পর্কিত রংগিন ছবি ও লেখা। দিনে কমপক্ষে ২০ বার এবং বছরে ৭৩০০ বার ছবি দেখে তামাক ব্যবহারীগণ নিরুৎসাহিত হবেন। ফলে তামাকের ব্যবহার কমে আসবে।
বাংলাদেশে ২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ সালের সংশোধিত এবং ২০১৫ সালে প্রণীত বিধিমালা অনুযায়ী তামাক কোম্পানীগুলো কর্তৃক সিগারেটের প্যাকেট এবং তামাকের বিভিন্ন মোড়কে ৫০ ভাগ পর্যন্ত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যবহার করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আছে। এর ব্যত্যয়ে কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয় বলা আছে। কিন্তু বেশিরভাগ কোম্পানী তা মেনে চলছে না। ফলে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও তামাকবিরোধী প্রতিষ্ঠান যেমন- ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, প্রজ্ঞা, প্রত্যাশা, আধূনিক, মানবিক, আহছানিয়া মিশন, অ্যান্টি টোবাক্যু মিডিয়া অ্যালায়েন্স, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ, সীমান্তিক, বিসিসিআইসহ আরো অন্যান্য সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সংগঠনগুলোর কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল তামাক কোম্পানীগুলোকে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ছাপানোর বিষয়ে বাধ্য করা।
তামাকবিরোধী কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্ব পরিমন্ডলে প্রশংসিত হয়েছে। সরকারের কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এদেশে তামাকবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো ২০০৫ সালে প্রণীত আইনের সংশোধিতে যা ২০১৩ সালের এপ্রিলে হয়েছে এবং সংশোধনীর পর ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সংশোধনী আইনে জরিমানার হার ৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা, ধুয়াবিহীন তামাকজাত পদার্থ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় আনা, সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কবাণী ৫০% ভাগ পর্যন্ত রাখা ইত্যাদিসহ আরো নানা কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং গৃহীত এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলসহ বিভিন্ন ধূমপানবিরোধী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণা, সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রকাশনা এবং তামাক ও তামাকজাত পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও আইনের বাস্তবায়নসহ জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের বিবিধ কাজ উল্লেখযোগ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শিশুপার্ক, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস, বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, ফেরি, প্রেক্ষাগৃহ, আচ্ছাদিত প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোন স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোন বা সকল স্থানে, মোটরগাড়ি, বাস, রেলগাড়ি, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সকল প্রকার জন-যানবাহন, উড়োজাহাজ এবং সরকার গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্দিষ্টকৃত বা ঘোষিত যে কোন যানে প্রকাশ্যে ধূমপানে শাস্তির কথা সম্বলিত পোস্টার বা ব্যানার টাঙালে মানুষ সচেতন হবে। সকলে সক্রিয় হলে আইনের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এর পরই অবস্থান করছে নেপাল ও মিয়ানমার। ক্যাম্পেন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-এর এক প্রস্তাবনাপত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তামাকের বর্তমান কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল। বলা হয়েছে, সম্পূরক কর, মূল্যে শতাংশ হিসেবে ধার্য রয়েছে। তামাক পণ্যের ধরণ এবং ব্রান্ডভেদে সম্পূরক করের উল্লেখযোগ্য তফাৎ রয়েছে। দামি ব্রান্ডের তুলনায় সস্তা ব্রান্ডের ওপর করের মাত্রা অনেক কম।
এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন- ‘২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিমূর্ল করা’ বাস্তবায়নে অবিলম্বে একটি কার্যকর শুল্কনীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর শুল্কারোপের মাধ্যমে প্রতিবছর তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে যাতে তামাকপণ্য ক্রমশ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অবিলম্বে তামাকের বিদ্যমান শুল্ক-কাঠামোর পরিবর্তে কার্যকর তামাক শুল্কনীতি প্রণয়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে ও এফসিটিসির আলোকে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করলে অবশ্য ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার নির্মূল সম্ভব।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, ‘তামাকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে সভা-সমাবেশ ও পথ নাটকের মাধ্যমে তামাকের ক্ষতিকর দিক তরুণদের বুঝানো সহজ। প্রচারণার ক্ষেত্রে এনজিও সংস্থার পাশাপাশি সাংবাদিকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করতে পারে বলে তিনি দাবি করেন’।