জমিদার ও অত্যাচার

শরিফ সাইদুর

`মীরজাফর` শব্দটি যেমন `বিশ্বাসঘাতকতার` সমার্থক, `রাজাকার` শব্দটি যেমন `দালাল` এর সমার্থক, তেমনি `জমিদার` শব্দটি `অত্যাচারের` সমার্থক। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই শব্দগুলো এই ব্যাবহারিক অর্থে পৌঁছেছে।

জমিদারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে হ্যাংরিংটন বলেন, “এদেশের জমিদাররা এমন একশ্রেণির জীব যাদের এককথায় প্রকাশের জন্য আমাদের ইংরেজি ভাষায় কোন শব্দ নেই।” উল্লেখ্য, হ্যাংরিংটন ১৭৮০ থেকে ১৮২৩ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলায় চাকরি করেছেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণার আঠারো-উনিশ বছর পর এ বন্দোবস্ত পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি ঘটন করা হয়। কমিটি Fifth Report পেশ করেন। সেখানে জমিদারদের সম্পর্কে বলা হয়, Idiots or of weak understanding; poor creatures sunk in sloth and debauchery, extravagant, necessitous and therefore exacting; ignorant and rapacious, herbourers of decoits, obstructive zemindars, more plague than profit.

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ইডিয়ট, নির্বোধ, উচ্ছৃঙ্খল, অমিতব্যায়ী, স্বেচ্ছাচারী, ডাকাতপোষক ও নিষ্ঠুর— এগুলো হলো জমিদারদের বিশেষণ।

মোঘলদের সময় বা তার পূর্ববর্তী শাসনামলেও বাংলায় প্রচলিত কোনো জমিদার ছিল না। যারা জমিদার হিসেবে পরিচিত পেতেন তারা ছিলেন রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির খাজনা আদায়ের কর্মচারী। জমির উপর তাদের কোনো দখলি স্বত্ত্ব ছিল না। সরকারের রাজস্ব আদায়ের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো, যার কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না। আর জমির সত্যিকার মালিক ছিল কৃষক, জমিদার না।

কিন্তু ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও যাচ্ছেতাইভাবে খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ও, যখন বাংলার তিনভাগের একভাগ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায় তখনও ইংরেজরা পূর্ববর্তী বছরগুলোর চেয়ে বেশি খাজনা আদায়৷ যার সম্পূর্নভাবে ছিল জোরপূর্বক।

এভাবেই চলতে থাকলে বিভিন্ন পর্যালোচনার পর লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। যেসব জমিদারেরা একসময় ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদের করে দেয়া হলো জমির মালিক। জমিদারেরা খাজনা আদায় করবে আর এই খাজনার নির্দিষ্ট অংশ ইংরেজদের প্রদান করবে। এর ফলে বাংলার কৃষক ও গরিব শ্রেণির উপর নেমে আসে ১৫৭ বছরের দুর্গতি। সেই থেকে বাংলার কৃষকদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের যে চিত্র তৎকালীন পত্রিকাগুলোতে ফুটে উঠেছে সেগুলো পড়লে গা শিহরিত হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে জমিদারদের সে অত্যাচারের চিত্র ভুলে গিয়ে বর্তমানে অনেকের কাছে জমিদার শব্দটা আভিজাত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। পুরাতন জমিদার স্থাপনা দেখতে আভিজাত্য মনে হলেও জমিদারেরা সেখানে থাকতেন কমই। নির্যাতনের যাবতীয় কলকাঠি আর গরিবদের চুষে নিতেন `কলকাতা`য় বসে বসে।

খাজনা ঠিকভাবে পরিশোধ করতে না পারলে কৃষকদের প্রতি কি রকম অত্যাচার করা হতো তার একটি তালিকা সে সময় `তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা`য় প্রকাশ হয়। নিচে সে তালিকাটি দেয়া হলো:

১. দণ্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত
২. চর্মপাদুকা প্রহার
৩. বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন
৪. খাপরা দিয়ে কর্ণ ও নাসিকা মর্দন
৫. ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ
৬. পিঠে দুহাত মোড়া দিয়ে বেঁধে বংশ দিয়ে মোচড়া দেওয়া
৭. গায়ে বিছুটি দেওয়া
৮. হাত পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা
৯. কান ধরে দৌড় করানো
১০. কাঁটা দিয়ে হাত দলন। দুখানা কাঠের বাখারির একদিকে বেধে তার মধ্যে হাত রেখে মর্দন করা। এই যন্ত্রটির নাম কাঁটা।
১১. গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদে ইটের উপর পা ফাঁক করে দুহাত ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা
১২. প্রবল শীতের সময় জলে চুবানো
১৩. গোনীবদ্ধ করে জলমগ্ন করা
১৪. গাছে বা অন্যত্র বেধে টানা দেওয়া
১৫. ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরে রাখা
১৬. চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা
১৭. কারারুদ্ধ করে উপবাসী রাখা
১৮. ঘরের মধ্যে বন্ধ করে লঙ্কা মরিচের ধোঁয়া দেওয়া

তথ্যসূত্র:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক- বদরুদ্দীন উমর
বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা- বিনয় ঘোষ
আত্মপরিচয়ের সন্ধানে- এবনে গোলাম সামাদ।

আরও পড়ুন...