জিব্রাল্টার প্রণালী এবং মুসলমানদের স্পেন জয়

পিবিএ ডেস্ক: জিব্রাল্টার নামটি আরবি জবাল আত তারিক থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ তারিকের পাহাড়। স্পেন জয়ী মুসলিম সেনাপতি জিয়াদ ইবনে তারিকের সম্মানার্থে এই নামকরণ করা হয়েছিল, যিনি ৭১১ সালে সর্ব প্রথম স্পেনের এই উপদ্বীপটি জয় করেছিলেন।

সেনাপতি তারিক ৭১১ থেকে ৭১৮ সাল পর্যন্ত ভিসিগথ শাসিত হিস্পানিয়ায় মুসলিম বিজয় অভিযানের একজন সেনানায়ক। ইবেরিয়ান ইতিহাসে তাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেনা কমান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের আদেশে তিনি একটি বিরাট বাহিনীকে মরক্কোর উত্তর উপকূল থেকে নেতৃত্ব দেন। জিব্রাল্টারে তিনি তার সৈন্যসমাবেশ করেন।

জিব্রাল্টারে পৌঁছেই তারিক বিন জিয়াদ তার এবং তার সৈন্যদের বহনকারী সব নৌযান পুড়িয়ে দেন। এটি দেখে তার একজন সৈন্য যখন হতবুদ্ধি হয়ে তার কাছে জানতে চান, কেন তিনি এমন করলেন? তারা এখন ফিরবে কেমন করে? তারিক তখন শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ফিরে যাবার জন্য তো আমরা আসিনি। হয় বিজয় হবে নতুবা মৃত্যু’। যুদ্ধে জয়লাভের ব্যাপারে এমনই বদ্ধপরিকর ছিলেন তারিক বিন জিয়াদ।

তারিকের সেনাবাহিনীতে মাত্র ৭০০০জন সৈন্য ছিল। তার সাথে মুসা বিন নুসাইর আরও ৫০০০সৈন্য পাঠিয়েছিলেন বলে কথিত আছে।

স্পেনের সম্রাট রডেরিক তারিকের এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য এক লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন বলে জানা যায়। তবু তারিকের অসাধারণ নেতৃত্ব, তার সৈন্যবাহীনির অসীম সাহসীকতা ও বীরত্বের কাছে হার মানতে হয়েছিল রডেরিককে।

রডেরিকের বিশাল সৈন্যবাহীনিকে মোকাবিলা করতে হবে শুনে প্রথমে তো তারিকের সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়। তারা সংখ্যায় এত কম ছিল যে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের ছিল অসীম সাহসী আর প্রেরণাদায়ী এক নেতা, তারিক বিন জিয়াদ। জানা যায়, যুদ্ধের পূর্বে তার সৈন্যবাহীনিকে সামনে রেখে তারিক বিন জিয়াদ এক যুগান্তরী ভাষণ দিয়েছিলেন।

তারিক বিন জিয়াদ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ” হে আমার সৈন্যগণ, কোথায় পালাবে তোমরা? তোমাদের পেছনে সাগর, আর সামনে শত্রু। তোমাদের কাছে আছে কেবল দৃঢ়তা এবং সাহস। মনে রেখো, এদেশে তোমরা সেই এতিমদের চেয়েও দূর্ভাগা যাদের অর্থলোভী মালিকরা তাদের বিক্রি করে দেয়। তোমাদের সামনে শত্রু, যাদের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু তোমাদের শুধু তলোয়ার ব্যতীত কিছুই নেই। তোমরা বেঁচে থাকতে পারবে কেবলমাত্র যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবন ছিনিয়ে আনতে পারো।

তোমাদের সামনে আছে শত্রুকে পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনার সুবর্ণ সুযোগ। যদি তোমরা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো তবে জয় নিশ্চিত। ভেবোনা আমি তোমাদের বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে যাব, আমিই সবার সামনে থাকব এবং আমার বাঁচার সম্ভাবনাই সবচেয়ে ক্ষীণ।” কাজ হয়েছিল তারিকের এই বক্তৃতায়। উদ্দীপিত হয়েছিল সৈন্যরা। তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা চা্ইলে কোন বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

রডেরিকের ১,০০,০০০ সৈন্যও তাই তারিকের মাত্র ১২০০০সৈন্যকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। রডেরিকের ১ লক্ষ সৈন্যও তারিকের মাত্র ১২ হাজার সৈন্যকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

যুদ্ধের সময় তারিক বিন জিয়াদ তার সৈ্ন্যদলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে কর্ডোভা, গ্রানাডা ও অন্যান্য অঞ্চল জয় করতে পাঠান। এসময় তিনি মূল সেনাদলের সাথে অবস্থান করেন। তারা টলেডো ও গুয়াদালজার জয় করে।

৭১১ সালের ১৯জুলাই হিস্পানিয়ার (স্পেন) গুয়াডালেট নামক স্থানে মুসলিমদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ভিসিগথিক রাজা রডেরিক পরাজিত ও নিহত হন। এর ফলে ভিসিগথ রাজ্যে তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিমরা চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে।

স্পেনে মুসলিমদের এই বিশাল জয়ের খবর শুনে তড়িঘড়ি করে স্পেনে আসেন মুসা বিন নুসাইর। এরপর তারিক বিন জিয়াদ এবং মুসা বিন নুসাইর দুই বীর সেনাপতি মিলে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করেন চরম সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে। এ বিজয়ের পর প্রায় সাড়ে সাতশ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্পেন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আর এ বিজয়গুলো এত কম সময়ের মধ্যে, আর এত সফলভাবে এসেছিল যে তারিক বিন জিয়াদের নাম মধ্যযুগের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে খুব মর্যাদার সাথে উচ্চারিত হয় আজও।

পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এটি অধিকার করার পর জাবাল আত তারিক হয়ে যায় জিব্রাল্টার।

জিব্রাল্টার প্রণালী (ইংরেজি: Strait of Gibraltar) পূর্বে ভূমধ্যসাগরকে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযোগকারী সমুদ্র প্রণালী। এটি উত্তর আফ্রিকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপ থেকে পৃথক করেছে। প্রণালীটি ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এর প্রস্থ অবস্থানভেদে ১৩ থেকে ৩৯ কিলোমিটার হতে পারে। প্রণালীর মধ্য দিয়ে একটি ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ও ৩০০ মিটার গভীর চ্যানেল চলে গেছে।

জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে অনবরত আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পানি ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করছে এবং পশ্চিমমুখী একটি অন্তঃপ্রবাহ ভূমধ্যসাগরের লবনাক্ত পানি আটলান্টিক মহাসাগরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...