জীবনজীবিকার প্রশ্নকে পিছনে ঠেলতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি: সিপিএম

সিপিএম সাধারণ সম্পাদক

পিবিএ ডেস্ক: জীবনজীবিকার প্রশ্নকে পিছনে ঠেলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী যুদ্ধজিগিরের ভাষ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। এর ভিত্তিতে বিপুল রায় পেয়েছে তারা।

সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর দু’দিনব্যাপী বৈঠকের পরে সোমবার এই কথা বলা হয়েছে।

পলিট ব্যুরো পার্টি ও বামপন্থীদের বড় বিপর্যয়ের গভীর পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণ আন্দোলনের ভিত্তিতে পার্টি ও বামপন্থীদের রাজনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচিও গ্রহণ করা হবে। ২৬-২৭ মে দিল্লিতে পলিট ব্যুরোর এই বৈঠক হয়েছে। এদিন পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি-এনডিএ বিপুল এবং সুস্পষ্ট রায় অর্জন করেছে। তামিলনাডু, অন্ধ্র প্রদেশের মতো অল্প কয়েকটি রাজ্য বাদে প্রায় সমস্ত বিরোধী দলেরই বিরাট পরাজয় হয়েছে। এবারের নির্বাচনে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলি, এমনকি তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলিতেও বড়ো রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। পলিট ব্যুরো বলেছে, এনডিএ সরকারের গত পাঁচ বছরের শাসনে জীবনজীবিকার ওপর যে বিপুল সমস্যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেসব এড়িয়ে সাফল্যের সঙ্গে একটি ভিন্ন জনমত তৈরিতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার মতো বিষয়গুলি জড়িয়ে জনমনে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী যুদ্ধজিগিরের ভাষ্য গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে জনগণের প্রতিদিনের উদ্বেগ ও সঙ্কটের অন্য সমস্ত বিষয়ই আলোচনার কেন্দ্র থেকে সরে যায়। পলিট ব্যুরো বলেছে, এসবে সাহায্যের জন্য নানান ধরনের উপাদানের সংমিশ্রণে মোদীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছে। মানুষের মধ্যে এই বার্তা পৌঁছে দিতে বিরাট আকারে ডেটা অ্যানালিটিক এবং তৃণমূল স্তরে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহায়তায় প্রযুক্তি এবং তার কৃৎকৌশলগুলি কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিপুল অর্থশক্তির বিনিময়ে সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশও একাজে সঙ্গত দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও এই ধরনের ভাষ্য গড়ে তোলার অনুমোদন দিয়েছে। আরএসএস সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলির বিরাট ব্যবস্থাপনা এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে।

পলিট ব্যুরো বলেছে, সিপিআই(এম)’র শক্তিশালী ঘাঁটিগুলিতেও আমাদের নির্বাচনী ভিত্তির বিরাট ক্ষয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। এই ক্ষয়ের কয়েকটি কারণ নিয়ে পলিট ব্যুরো আলোচনা করেছে। আগামী ৭থেকে ৯জুন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হবে। রাজ্যগুলির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সেই সভায় আলোচনা হবে। নির্বাচনী অভিজ্ঞতার আন্তরিক আত্মসমীক্ষার ভিত্তিতে যথাযথ শিক্ষা নিতে সভা থেকে একটি রিপোর্ট তৈরি হবে। তার আগে আমাদের শক্তিশালী রাজ্যগুলিতে রাজ্য কমিটিগুলির সভা হবে। সেখানে আত্মসমালোচনার ভিত্তিতে পার্টির নির্বাচনী ফলাফলের মূল্যায়ন করা হবে। এর পরেই কেন্দ্রীয় কমিটি প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থাগুলি চিহ্নিত করবে যাতে সিপিআই(এম)’র স্বাধীন শক্তি আরও জোরদার করা যায় এবং জনপ্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সক্ষমতা বাড়ানো যায়।

সপ্তদশ লোকসভায় পার্টির তিনজন বিজয়ী প্রার্থীকে (২জন তামিলনাডুর এবং একজন কেরালার) যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে সিপিআই(এম)। পলিট ব্যুরো বলেছে, প্রবল সন্ত্রাস এবং হিংসার পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় ভোট হয়েছে। ভোটদানের কাজে সিপিআই(এম) সমর্থকদের শারীরিকভাবে আটকানো হয়েছে, এমন প্রচুর খবর এসেছে। ‘অবাধ এবং সুষ্ঠু’ নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। সেই আশ্বাস বাস্তবায়নের জন্য আমরা বারবার নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কানে তোলা হয়নি। নির্বাচন চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গে ২জন এবং ত্রিপুরায় ১জন বামফ্রন্ট সমর্থকের প্রাণ গিয়েছে। দু’টি রাজ্যেই ভোট-পরবর্তী হিংসা চলছে। এই হিংসা বিপজ্জনকভাবে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষের দিকেও মোড় নিচ্ছে। পলিট ব্যুরো বলেছে, নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই হরিয়ানা, মধ্য প্রদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের খবর আসতে শুরু করেছে। ‘নতুন সরকার সর্বস্তরের মানুষের মনে আস্থা তৈরি করবে এবং সকলের উন্নয়ন সুনিশ্চিত করবে’ (সব কা সাথ, সব কা বিকাশ) বলে ভাবী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ঘোষণা করেছেন, এসব হামলার ঘটনা তার উলটো কথাই বলছে। পলিট ব্যুরো বলেছে, স্পষ্টতই ভারতীয় জনগণ এবং আমাদের দেশের সামনে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র, সাংবিধানিক সংস্থাগুলি, জনগণের অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং জীবনজীবিকার সমস্যাগুলি নিরসনের স্বার্থে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর কাছে সিপিআই(এম) জোরালো আবেদন জানাচ্ছে। আমাদের সামাজিক কাঠামোর সযত্নলালিত সম্প্রীতি আরও জোরদার করতে এবং উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে ভারতীয় জনগণের সমস্ত অংশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে পার্টির সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি বলেন, নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ও এনডিএ বিপুল রায় পেয়েছে। তামিলনাডু, অন্ধ্র প্রদেশের মতো কয়েকটি রাজ্য ছাড়া বিরোধীরা খারাপ ফল করেছে, বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে। বামপন্থীদের গুরুতর বিপর্যয় হয়েছে, বিশেষ করে শক্তিশালী এলাকায়। গত পাঁচ বছর নোটবাতিল, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, কৃষি সঙ্কটের মতো বিষয়ে জনগণের যে দুর্দশা হয়েছে, বিজেপি তা থেকে রাজনৈতিক ভাষ্যকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিকল্প ভাষ্য তৈরি করেছে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী যুদ্ধজিগিরের মাধ্যমে। পুলওয়ামার পরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাকে সামনে এনে ওই ভাষ্য রুটিরুজির প্রশ্নকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ বিশ্লেষণ করে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি তুলে ধরতে বার্তা পাঠানো হয়েছে। নিচের স্তরে সামাজিক বিন্যাসও করা হয়েছে। যেমন উত্তর প্রদেশে অ-যাদব অনগ্রসর এবং অ-জাতভ দলিতদের বিশেষ ভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে এবারের নির্বাচনে। আরএসএস, তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠন এবং এনজিও এই কাজে সাহায্য করেছে। ইয়েচুরি বলেন, বামপন্থীদের বিরাট পরিমাণ শক্তিক্ষয় হয়েছে। কয়েকটি রাজ্যের সম্পাদকমণ্ডলীর প্রাথমিক রিপোর্ট পেয়ে পলিট ব্যুরো আলোচনা করেছে। ৭-৯জুন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠকে বিশদে পর্যালোচনা হবে। তার আগে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কেরালার রাজ্য কমিটিও বৈঠকে বসবে।

ইয়েচুরি বলেন, পলিট ব্যুরো মনে করেছে এই নির্বাচনী ফলাফলের গভীর পর্যালোচনা করা দরকার। গণ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বামপন্থীদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি করতে হবে। সংগ্রাম আন্দোলন গড়ে তোলা হলেও রাজনৈতিক ভাবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। যে রাজনৈতিক ভাষ্য বিজেপি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল তা জীবনজীবিকার প্রশ্নকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে তা নিয়ে বামপন্থীদের শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে। বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি করা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষমতাবৃদ্ধি কীভাবে করা সম্ভব, তা গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি পেশ করা হবে। ইয়েচুরি বলেন, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে হিংসার মধ্যে দিয়ে এই নির্বাচন হয়েছে। ত্রিপুরায় একটি কেন্দ্রে ৮৫শতাংশ বুথে রিগিং হয়েছে। বামপন্থীরা এবং অন্য বিরোধীরা পুনর্নির্বাচন দাবি করেছিল। নির্বাচন কমিশন ১০শতাংশ বুথে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। তা-ও সারা দেশে সবচেয়ে বেশি। নির্বাচন কমিশন তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে ইয়েচুরি বলেন, কমিশন নিরপেক্ষতা বজায় রাখেনি। ইয়েচুরি বলেন, নির্বাচনের পরে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সংখ্যালঘুদের ওপরে আক্রমণের খবর আসছে। এই ইঙ্গিত আশঙ্কার। নরেন্দ্র মোদী এনডিএ’র সাংসদদের সভায় যে বার্তা দিয়েছেন, তার সম্পূর্ণ বিপরীতে যাচ্ছে। এই ধরনের ঘটনায় ‘সবকা বিশ্বাস’-এর স্লোগান ধাক্কা খাচ্ছে। ইয়েচুরি বলেন, খুবই বড় চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে।

মূলত চারটি ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হবে। এক, সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্র ও তার ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করা, জনগণের অধিকার ও নাগরিক অধিকারকে রক্ষা করা, জনগণের জীবনজীবিকার প্রশ্ন। ইতিমধ্যেই পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে, এখন জনগণের জীবনজীবিকার ওপরে আক্রমণ ফের শুরু হবে। সিপিআই(এম) অন্যান্য শক্তির সঙ্গে মিলিত ভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করার লড়াইয়ে থাকবে। ভারতের সামাজিক বৈচিত্র্য রক্ষা করার লক্ষ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য সিপিআই(এম) জনগণের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে ইয়েচুরি বলেন, ২০১১ এবং ২০১৯-র পরিস্থিতি এক নয়। বিজেপি-তৃণমূল যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা করেছে তার ফলে গণতান্ত্রিক পরিসর কমে গেছে।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...