পিবিএ ডেস্ক: শরীরের বেশ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোই করোনায় আক্রান্ত হয়। যেমন- মাথা, নাক, ঘাড়, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, রক্তনালী,পাকস্থলী, কিডনি, লিভার, এবং পা। তবে সবার সব অঙ্গ একসঙ্গে আক্রান্ত হয় না।
মস্তিষ্ক:
করোনা ভাইরাস শরীরের সেই সব অংশকে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে বা সেখানে গিয়ে বসে, যেখানে ACE2 নামের একধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন থাকে। ফুসফুসের মতো মস্তিষ্কেও এই ACE2 অনেক বেশি থাকে। সমস্যাগুলো হল:
* মাথা ব্যথা করা
* মস্তিষ্কের ইনফ্লেমেশনো
* মনোযোগ কমে যাওয়া
* মাথা ভার ভার লাগতে পারে
করোনা আক্রান্তদের ১০% মস্তিষ্কের সমস্যায় ভুগতে পারেন। তবে সমস্যাগুলোর কিছু কিছু সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও দেখা দিতে পারে।
ঘাড়:
ঘাড় ব্যথা করতে পারে। আক্রান্ত হবার কিছুদিন পর প্রথমে গলা ব্যথা শুরু হয়। এই গলা ব্যথার কারণ – গলার একটি গ্লান্ড আক্রান্ত হয় বলে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড। এতে subacute thyroiditis নামের একটি সমস্যা হয়। এটি একটি ইনফ্লেমেশন। মনে রাখবেন – ইনফ্লেমেশন কিন্তু ইনফেকশন নয়। ইনফেকশনের কারণে ইনফ্লেমেশন হয়। ইনফ্লেমেশন হলো ইনফেকশনের কারণে শরীরের একটি পাল্টা প্রতিক্রিয়া। সাধারণত মামস ভাইরাসের কারণে এই subacute thyroiditis সমস্যাটি হয়।
সম্প্রতি ইতালিতে খুব অল্প কিছু করোনা আক্রান্তদের মধ্যে এটি দেখা গেছে। এতে আক্রান্ত হলে প্রথমে গলা বেশি ব্যথা করে, গলার সামনের অংশ একপাশে ফুলে যায়, ঘাড়ের পেশিগুলো ব্যথা করতে শুরু করে। থাইরয়েডের অন্য কোনো কমপ্লিকেশনের দিকে না গেলে কয়েকদিন পর ব্যথা চলে যায়।
ফুসফুস:
ফুসফুসে কি হয়, সবাই জানে এতদিনে। ফুসফুসে আক্রমণের তিনটি স্তর। প্রথম স্তরে নাক, মুখ দিয়ে ভাইরাসটি শরীরে ঢুকে গলায় বাসা বাঁধে। শুরু হয় হালকা গলা ব্যথা। দ্বিতীয় স্তরে কদিন পর ফুসফুসের গিয়ে বসে। সেখানে মস্তিষ্কের মতো ACE2 প্রচুর থাকে। ফুসফুসের ভিতরের কোষগুলো মিউকাস নামের একটি উপাদান বের করে, যার কাজ হলো ফুসফুসকে ধুলোবালি, জীবাণু এসব থেকে পরিষ্কার রাখা।
ফুসফুসে এপিথেলিয়াল ধরনের কোষে সিলিয়া নামক এক ধরণের গঠন থাকে, এদের কাজ হলো – ফুসফুসের কোষের উপর জীবাণু, ধুলাবালি, পরাগরেণু, বাহিরের কোনো কিছুকেই বসতে না দেয়া। ব্যাঙের ছাতার মতো দুলে দুলে জীবাণুদের সরিয়ে দেয় সিলিয়া এবং মিউকাস তখন সেগুলোকে ধুয়ে ফুসফুসের বাহিরে ঠেলে দেয়। আমরা ঠিক এই কারণে যখন কাশি দিয়ে এক দলা কফ ফেলি, এই কফে তাই ভাইরাস থাকতে পারে ! অনেক জীবাণুও থাকে। এই জন্যে যেখানে-সেখানে কফ ফেলবেন না। নিজের কফ দিয়ে নিজের সন্তানকেই আক্রান্ত করবেন। এই লেখাটি পড়ার পর আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করবেন – যেখানে-সেখানে কফ ফেলবেন না, কাশি এলে হাত দিয়ে মুখ ঢাকবেন, পকেটে টিসু থাকলে টিসুতে মুখ মুছবেন, সেই টিসু কোনো ডাস্টবিনে ফেলবেন। দৈনন্দিন জীবনে এমন সামান্য পরিচ্ছন্নতাটুকু আপনাকে যেমন ভালো রাখবে, অন্যকেও ভালো রাখবে।
এই সিলিয়াগুলোর বাহিরে ACE2 বসে থাকে। করোনা ভাইরাসগুলো এই সিলিয়া গুলোর উপর বসে কোষের ভিতর ঢুকে কোষগুলোকে আক্রান্ত করলে সিলিয়াগুলো আর তাদের কাজটি করতে পারে না। তখন বার বার মিউকাস জমে যায় সামান্য বাতাসে ! ফুসফুস চায় তা বের করে ভালোভাবে বাতাস নিতে, আর তাতেই কাশি শুরু হয়। তখন ঘনঘন আক্রান্ত হন, ঘনঘন কাশতে থাকেন। আরো কয়েকদিন যেতেই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।
তৃতীয় স্তরে শরীর তেড়ে আসে, এন্টিবডি তৈরি করে, সেই এন্টিবডিগুলো ভাইরাসকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে।ভাইরাস আর এন্টিবডির যুদ্ধ এতো প্রবল হয়ে ওঠে যে cytokines নামের একটি রাসায়নিক উপাদান বেরিয়ে আসে, সে আরো বেশি বেশি এন্টিবডি ডেকে নিয়ে আসে, ঝড়টিকে বলে cytokine storm।। এতে ফুসফুসের অ্যালভিওলার প্রকোষ্ঠগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত মৃতকোষ, জল, মিউকাস, পুঁজ ইত্যাদিতে ভরে যায়। এই প্রকোষ্ঠে বাহিরের অক্সিজেন ঢুকে এবং শরীরের কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়। কিন্তু প্রকোষ্ঠটি মৃত কোষ সহ জল, পুঁজে ভরে যায় বলে বাতাস ঢুকতেও বাধা পায়, আবার বেরও হতে পারে না। নিউমোনিয়া বেড়ে গিয়ে পুরো শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তখনই দরকার পড়ে ভেন্টিলেটর মেশিন।
হৃদপিণ্ড:
প্রথমে ভাবা হতো শুধুমাত্র ফুসফুসকে এই ভাইরাস সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে। কিন্তু সময় গড়াতে বের হয়ে এলো – আক্রান্তদের প্রতি পাঁচজনে একজনের হৃদপিণ্ডে এটি আঘাত হানে। এমনকি সুস্থ দেহ, পূর্ব থেকে হার্টে কোনো সমস্যা নেই, এমনদের; সাথে তরুণ তরুণীদের হার্টকেও এটি আক্রান্ত করতে পারে। হার্টের কারণে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়
* অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন
* হার্ট মাসলের ক্ষতি যা থেকে Myocarditis হতে পারে
* হার্ট অ্যাটাক বিশেষত Ischemic heart attack হতে পারে
* প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং রক্ত চলাচলে বাধা
* করোনারি হার্ট ডিজিজ হতে পারে ব্লাড ক্লট থেকে
* হার্ট ফেইলিউর; এবং সবশেষে হৃদয় থেমে যেতে পারে।
* সরাসরি হার্টের কোষে ঢুকে
* ফুসফুসের মাধ্যমে
ফুসফুস এবং ব্রেইনের মতো হার্টের কোষের আবরণে ACE2 প্রোটিন রিসেপ্টর থাকে প্রচুর। তাই ভাইরাসগুলো তাদের স্পাইক প্রোটিন দিয়ে হার্টের কোষে গিয়ে সহজে বসতে পারে। সাথে রক্তনালির ক্ষতি করে রক্তচলাচলে বাধা দেয়, রক্তনালী সরু করে ফেলে, এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
ফুসফুসে বাতাস ঠিকমতো পরিবর্তন না হতে পারলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। তাতে হৃদপিণ্ড কম অক্সিজেনের রক্ত পায়। অক্সিজেন কম পেলে হার্টের মাসলগুলো ঠিকমতো পাম্প করতে পারে না, তাতে পুরো রক্ত সরবরাহ হুমকিতে পড়ে। শরীরের সব জায়গায় রক্ত ঠিক মতো যায় না। হার্ট মাসল ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
কিডনি:
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দেখা গেছে যে, প্রতি চারজনের একজন কিডনি সংক্রান্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়। এমনকি সুস্থ হবার পর কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। কিডনি ডেমেজ থেকে কিডনি ফেইলিউর, কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনি অনেকাংশে অকেজো হয়ে যাওয়া, এমনসব সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। সমস্যার তীব্রতায় ডায়ালাইসিসের দরকার হয়ে পড়ছে অনেক রোগীর।
হার্টের মতো কিডনিতেও অনেক ACE2 থাকে বলে কিডনির কোষ নেফ্রনের ভেতর ঢুকে কোষ মেরে ফেলে কিডনিকে অকেজো করতে পারে। ফুসফুসের অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষমতা কমে গেলে কিডনিতেও অক্সিজেনহীন রক্তের কারণে কিডনির কাজগুলো ঠিক মতো হয় না আর। রক্তে জমাট বাধলে বিশেষ করে কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলোতে এমন রক্ত জমাট বেঁধে কিডনির ফিল্টারিং কমিয়ে দেয়। তাতে শরীরের বর্জ্য ঠিকমতো বের হতে না পেরে শরীর নিজেই বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
রক্ত এবং রক্তনালী:
শুরুতে ধরা হতো রেসপিরেটরি ফেইলিউরে বেশি মারা যেত করোনা আক্রান্তদের। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে। এই সমস্যাটি চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলেছে। ওঈট তে রাখা এক তৃতীয়াংশ রোগী এই ব্লাড ক্লটের শিকার হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে মাইক্রো ক্লট, যা মূলত হার্ট, কিডনি, ফুসফুসের খুব ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলোতে কোনো এক অজানা কারণে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে।
রক্তনালীর ভিতরের দেহ আক্রান্ত হলে তা যে ইনফেকশন তৈরি করে তাতে রক্তনালীর স্ফীত হওয়া কমে যায়, রক্ত ঠিকমতো চলতে পারে না, তাতে রক্ত তার কণিকাগুলো নিয়ে বসে থেকে আরও পিণ্ড তৈরি করে। সেই পিণ্ডে অন্য আরও কিছু প্রোটিন যুক্ত হয়ে জমাট পিণ্ড করে ফেলে। তাতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কখনো সেই জমাট পিণ্ড কোথাও গিয়ে আটকে যায় ভালো করে। এমন করে কিডনিতে ফিল্টারিং কমিয়ে দেয়, হার্টে করোনারি ব্লক তৈরি করে, ব্রেইনে রক্ত এবং অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে স্ট্রোক করায়, তাতে ব্রেইনের যে অংশকে আঘাত করেছে স্ট্রোক করে, সে শরীরের যে অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা প্যারালাইসিস করে দিতে পারে। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও রক্তের এই জমাট অনেকদিন শরীরে থাকতে পারে।
পাকস্থলী:
বিশ ভাগ আক্রান্তের শরীরে ডায়রিয়া একটি কমন লক্ষণ। এটি আক্রান্ত হবার প্রথম দিকে হয়ে থাকে। কয়েকদিন থেকে চলে যায়। কিন্তু সুস্থ হবার পর পেটের অনেক সমস্যায় অনেকদিন ভুগতে পারেন। ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, কারণ ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ ডায়রিয়া হতে পারে সুস্থ হয়ে উঠবার কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। এসবের কারণ হলো করোনা ভাইরাস শুরু থেকেই পাকস্থলী এবং পরবর্তীতে অন্ত্রকে আক্রান্ত করে। পাকস্থলীতেও অঈঊ২ থাকে বলে করোনা ভাইরাস সহজে সেখানে গিয়ে বসে।
লিভার:
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে লিভারের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের তৈরিতে বাধা তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং রক্তের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে বলে যকৃতের কোষগুলোর ঠিকমতো কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। রাসায়নিক উপাদান গুলো উঠানামা করে। ঐসব উপাদানগুলো শরীরে নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে। ফলে নতুন কোষ তৈরিতেও বাধা পায়। সুস্থ হয়ে উঠলেও লিভার ফাংশনের অনেক কিছুতে ব্যাঘাত থেকে যায় অনেক দিন, এমনকি লিভারের কার্যক্ষমতা আগের চেয়ে হ্রাস পায়। লিভারের এফেক্ট গিয়ে পড়ে খাদ্যপরিপাকে এবং শরীরের পুষ্টি জোগানে।
অন্যান্য:
নাকে ঘ্রাণ নেবার ক্ষমতা কমে যায়, যা করোনা ভাইরাসের একটি স্বীকৃত লক্ষণ এখন। পায়ের কিছু আঙ্গুল অন্য ধরনের লাল হয়ে যেতে পারে, যাকে বলে কোভিড টো। খুব অল্প কিছু আক্রান্তের দেহে এই বিচিত্র লক্ষণটি দেখা গেছে। বাচ্চাদের বুক কিংবা পিঠের ত্বকে ফুসকুড়ি ছেয়ে যেতে পারে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে।
পিবিএ/এমএসএম