পিবিএ ডেস্কঃ গরমের দিনে টক খাবারের নাম মনে পড়লে জিভে পানি আসে বৈকি! অন্য ঋতুগুলিতে টকের তেমন সমাদর নেই। আয়ুর্বেদ মতে রস ৬টি—মধুর, অম্ল, লবণ, তিক্ত, কটু, কষায়, আর এগুলির সমন্বয়ে শরীরে বায়ু-পিত্ত-কফের বৃদ্ধি-হ্রাস হয়ে শরীরকে সুস্থ ও অসুস্থ করে তুলতে পারে। তাই সব ঋতুতে কম-বেশি ৬টি রসের ব্যবহার শরীরের পক্ষে খুবই উপযোগী।
টক খাবারঃ টক খাবার বলতে সাধারণত যেসব দ্রব্যের নাম মনের আনাচে-কানাচে ঘুরঘুর করতে থাকে, তার মধ্যে টক দই বাদ দিলে, বাকি রইল কিছু টক ফল, মোটামুটি সেগুলি হল— কাঁচা আম, কাঁচা ও পাকা তেঁতুল, কাঁচা ও পাকা চালতা, যে কোনও প্রকারের লেবু, কামরাঙা, আমড়া, জলপাই, কাঁচা ও পাকা কয়েতবেল, টোপাকুল, নোয়াড় বা শিলাকুল, চেরি প্রভৃতি। অসম সহ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে আমচুরের মতো ব্যবহৃত হয় অম্লবেতস ফল। এছাড়া কাঁচা-পাকা আনারসও এই তালিকায় এসে যায়।
সংক্ষিপ্ত আকারে এগুলির গুণাগুণ, ব্যবহারিক পদ্ধতি ও উপকারিতা সম্বন্ধে আলোচনা করা হলোঃ-
কাঁচা আমঃ এই ফলে ভিটামিন সি, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, কপার, বিটা ক্যারোটিন, ফাইবার, নায়াসিন, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিক, জিঙ্ক, আলফা ক্যারোটিন প্রভৃতি থাকে। কাঁচা আমে থাকে সাইট্রিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড, টারটারিক অ্যাসিড। ফলে এটি রক্তে অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করে। চরক সংহিতায় বলা হয়েছে—কচি আম রক্তপিত্তকর, মধ্যবয়সি আম পিত্তকর। পরবর্তীকালের সমীক্ষাতে দেখা যায়—কচি আম অম্ল, কষায়,রুচিকর, বায়ু ও পিত্তবর্ধক।
কাঁচা আমের মুখের কাছে যে আঁঠা থাকে, তা ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। খুব বেশি খাওয়া ভালো নয়। গর্ভাবস্থায় কাঁচা আম না খাওয়া ভালো।
দক্ষিণ বঙ্গে কাঁচা আম দিয়ে শোল মাছ খাওয়ার চল খুব বেশি। এই সময় প্রত্যেকটি হোটেলেও পাওয়া যায়। আমাদের প্রিয় কবির এটি বড়ই প্রিয় ছিল।
কাঁচা আম—লবণ, কাঁচা লঙ্কা ছেঁচাতে সামান্য সরিষার তেল মিশিয়ে রোদে বসিয়ে রাখতে হয়। দুপুরের এক ফাঁকে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার একটা আলাদা আমেজ আছে। এটি ক্লান্তি ও পিপাসা দূর করে, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কাঁচা আম বেশি খেলে পেট ব্যথা, বদহজম, আমাশা, ঠোঁটে ও মুখে প্রদাহ হতে পারে। গরমের দিনে কাঁচা-মিঠে আম খাওয়া বড়ই উপাদেয়। কাঁচা আম থেকে আমসি, আচার, আমচুর, কাসুন্দি, মোরব্বা, তেল আম, গোটা আমের সরষে আম প্রভৃতি তৈরি হয়। ডালে কাঁচা আম খাওয়া বা আম পোড়ার শরবত খুবই স্বাস্থ্যপ্রদ।
কাঁচা ও পাকা তেঁতুলঃ সারাবছর খেতে পারেন। অত্যধিক রুচিকর হজমে সহায়ক, তবে অল্প পরিমাণে খেতে হয়। রাতের দিকে না খাওয়াই ভালো। পুরাতন পাকা তেঁতুল খাদ্যগুণে ও ঔষধি গুণে অধিক সমৃদ্ধ; লবণের ক্ষতিকর প্রভাবকে তেঁতুল নষ্ট করতে পারে, সেজন্য লবণাক্ত অঞ্চলের লোকেরা তেঁতুল বেশি খেয়ে থাকেন। পুরাতন তেঁতুল অর্শ, আমাশা, প্রস্রাবের দোষে, কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে, পেটের রোগে, দাহ-প্রশমনে, সর্দি-কাশিতে, অগ্নিমান্দ্য ও অরুচিতে বিশেষ কার্যকর। তবে যাঁরা প্রকৃত অর্থে অম্বলের রোগে ভোগেন, তাঁরা সাবধানে খাবেন নতুবা খাবেন না। তেঁতুলে থাকে টারটারিক ও ম্যালিক অ্যাসিড।
কাঁচা ও পাকা চালতাঃ চালতায় ম্যালিক অ্যাসিড থাকে। ফলটি মধুর অম্ল-কষায় ধর্মী, রুচিকর, মুখশোধক, পিত্ত ও শ্লেষ্মার বিকারে কার্যকর এবং হৃদয়ের বলকারক। গুড়, রাঙালু, মূলো প্রভৃতি দিয়ে চালতার অম্বল বা টক তৈরি করা যায়। চাটনি ও মোরব্বা খুবই সুস্বাদু।
যে কোন প্রকারের লেবুঃ (পাতি, কাগজি, গোঁড়া, টাবা, শরবতি, কমলা, গন্ধরাজ) প্রভৃতি। এগুলির সাধারণ গুণ হল—অম্লরস, বায়ুনাশক, অগ্নিদ্দীপক, পাচক ও লঘু। এছাড়া এক একটি জাতের লেবুর বিশেষ বিশেষ গুণ থাকে। খাওয়ার পদ্ধতিও আলাদা। বাতাবি, কমলা ফলের মতো খাওয়া যায়। বাকিগুলো কোনটা ভাতে, ডালে, শরবতে ব্যবহৃত হয়। কমবেশি সবগুলিতে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, প্রোটিন প্রভৃতি থাকে। গরমের দিনে লবণ-চিনি-লেবুর রস দিয়ে তৈরি পানীয় শরীরের জলীয়াংশের ভারসাম্য রক্ষা করে। লেবুর আচার সারাবছর খাওয়া যেতে পারে। পাতিলেবু-কাগজি লেবু সারাবছরই কম বেশি পাওয়া যায়।
কামরাঙাঃ কাঁচা ফল স্বাদে অম্ল, পাকা ফল মধুর ও অম্ল স্বাদের, পিত্তবর্ধক, বলকারক, রুচিকর। এটিতে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, আয়রন, ভিটামিন-এ ও অন্যান্য কিছু খনিজ পদার্থ রয়েছে। এটির চাটনি, আচার, সরবত প্রভৃতি খুবই উপাদেয়।
আমড়াঃ কাঁচা আমড়া স্বাদে অম্ল, গুরুপাক, রুচিকর ও বায়ুনাশক। পাকা আমড়া মধুর ও কষায় রস, রুচিকর, স্নিগ্ন, বলকারক, শুক্রবর্ধক ও বহুমূত্র রোগে হিতকর। আমড়ার চাটনি বা অম্বল তৃপ্তিদায়ক এছাড়া দেশি মিষ্টি আমড়া ও থাইল্যান্ডের আমড়া পাওয়া যায়।
৭. জলপাই: এই ফলে সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে। আমাশা ও অতিসারে এটির চাটনি বা অম্বল উপকারী।
কুলঃ কাঁচা খেলে কফ ও পিত্ত বৃদ্ধি করে, তাই খাওয়া নিষেধ। পাকলে অম্লমধুর, তখন সেটি বায়ু-পিত্তের দোষ দূর করে। রুচিকর ও বলকারক। লবণ সহযোগে আচার তৈরি করে দীর্ঘদিন রাখা যায়। পাকা ফলের টক বা চাটনি উপাদেয় খাদ্য।
শিলাকুলঃ এই ফলটির গরমের দিনে ফলন বেশি। চাটনি করে লোকে খায়। স্বাদে অম্ল-মধুর- কষায় রস সমৃদ্ধ। স্বভাবে রুক্ষ ও গুরু হলেও কফ ও পিত্তনাশক, রুচিকর, অশ্মরী (মূত্রপাথুরী) ও অর্শনাশক। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ২/৩টি ফল লবণ সহযোগে কাঁচায় খেলে সহজে হজম হয়।
চেরিঃ পার্বত্য এলাকার গাছ হলেও নিম্নভূমিতে ভালোভাবে জন্মে ও ফল দেয় চেরি গাছ। এই গরমে খেতে পারেন কাঁচা আম সহ চাটনি বানিয়ে। ফলটি পিত্ত নিঃসারক ও বিরেচন ধর্মী, স্বাদে অম্লমধুর, পাকস্থলীর পক্ষে খুবই উপকারী। মুখ ও ফুসফুসের রোগনাশক, রুচিকর, তৃষ্ণা-বমি-হিক্কা প্রশমিত করতে পারে। এছাড়া এটি মস্তিষ্কের পক্ষে খুবই ভালো।
টক কীভাবে খাবেনঃ খেতে পারেন আনারসের চাটনি, তাতে মেশাতে পারেন কাঁচা আম আর পোনা মাছের ডিম। পোস্ত বাটা ও পুরাতন তেঁতুলের টক বা চাটনি খেতে পারেন। ডালে কাঁচা আম বা পুরাতন তেঁতুল মেশালেও টক ডাল তৈরি হয়। পাকা চালতা ও রাঙালু—গুড় দিয়ে অম্বল, কাঁচা তেঁতুলের সময় তার টক বা অম্বল— কত রকমেরই না টকের কাহিনী। এছাড়া টক পালং ও টক শুষুনি (আমরুল শাক) দিয়ে উপাদেয় চাটনি বানানো যায়। গরমে টক শুষুনি আপনা থেকেই বাগানে জন্মে।
টক দইঃ মিষ্টি দই-এর উপকারিতা নেই বললেই চলে। পেটের সমস্যা বৃদ্ধি করে। বরং টক দইতে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো থাকে, সেগুলোকে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া বলা হয়। দই তৈরির সময় এগুলি তৈরি হয় এবং শরীরে গিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
টক দইতে থাকে—ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, জিঙ্ক, প্রোটিন, ভিটামিন-বি১২, ফলিক অ্যাসিড প্রভৃতি। দুধের তুলনায় দইতে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ও ফলিক অ্যাসিড বেশি থাকে।
আয়ুর্বেদের বিচারে—গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতির দুধের মধ্যে গরুর দুধের দধি বা দই সর্বোৎকৃষ্ট। এটি হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, বায়ুনাশক, রুচিকারক, বলকারক, পুষ্টিকারক ও শুক্রবর্ধক আরও নানা প্রকারের গুণসম্পন্ন।
গরমের দিনে টক দই ফেটিয়ে ঘোল বা লস্যি করে খেলে উপকার মেলে। তবে মনে রাখবেন, মাছ-মাংস-ডিম প্রভৃতির যে কোন একটি দিয়ে আহার করলে, সঙ্গে সঙ্গে দই প্রভৃতি না খেয়ে ৩-৪ ঘণ্টা পরে খাওয়া উচিত। নিত্য দই সেবনে শরীর তরতাজা থাকে, মনোবল বৃদ্ধি পায়, কর্মক্ষমতা বাড়ে, হৃদয়ের বল বৃদ্ধি করে। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বৃদ্ধি হয়ই নানাভাবে খাওয়া যেতে পারে। ঘরে পাতা সামান্য টক হওয়া দই খাওয়া সবচেয়ে ভালো এবং নিরাপদ।
পিবিএ/এমআর