রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আমাদের নেতৃত্বের প্রতীক, আমাদের পথপ্রদর্শক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা।
শনিবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
আবদুল হামিদ বলেন, করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্বের জড়তা ও জরাজীর্ণতা ভেদ করে নতুনভাবে পথচলার বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। হেমন্তের এই রোদেলা অপরাহ্নে আপনারা আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। বিজয়ের মাস সন্নিকটে। সবাইকে বিজয় দিবসের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
তিনি বলেন, বক্তব্যের শুরুতে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদ ও ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আত্মদানকারী সব শহীদকে। স্মরণ করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব সূর্য সন্তানদের, যারা ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আপনারা জানেন বিগত দুই বছরে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন করেছি। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে উচ্চশিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে শিক্ষার প্রসার ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে জ্ঞানী-গুণী, শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও মানবিকগুণসম্পন্ন অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষ। দেশের ভৌত ও গুণগত উন্নয়নে যাদের অবদান চিরভাস্বর হয়ে আছে।
তিনি বলেন, আপনারা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম এবং এর অনেক পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও শিক্ষকদের দেখলে বা তাদের কথা শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতো। কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আপনাদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই কিছুসংখ্যক অসাধু লোকের কর্মকাণ্ডের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজের মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, পরিচালন, মূল্যায়ন ও উন্নয়নকে ঘিরে। কিন্তু ইদানীং পত্রিকা খুললেই মনে হয় পরিবার-পরিজন ও অনুগতদের চাকরি দেওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রশাসনিক ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়াই যেন কিছু উপাচার্যের মূল দায়িত্ব। আবার অনেক শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাকে ঐচ্ছিক দায়িত্ব মনে করেন। বৈকালিক কোর্স বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়াকেই তারা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। ছাত্র-শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের সঙ্গে এটি খুবই বেমানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই কৃতী ও সেরা ছাত্র ছিলেন। আমার বিশ্বাস আপনারা যেকোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের সাক্ষর রাখতে সক্ষম হতেন। কিন্তু জীবনের মহান ব্রত হিসেবে শিক্ষকতাকেই আপনারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই শিক্ষক হিসেবে নিজ পেশার প্রতি দায়িত্বশীল থাকবেন এটাই সবার প্রত্যাশা।
আবদুল হামিদ বলেন, আমরা চাই উপাচার্যের নেতৃত্বে ও ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হোক অর্থাৎ Centre of Excellence হিসেবে গড়ে উঠুক। শিক্ষকরা হয়ে উঠুন সমাজে মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকসহ যেকোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
তিনি বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো এক একটি গবেষণাগার। আর মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে মানসম্পন্ন গবেষণা ও গবেষণালব্ধ কাজের প্রয়োগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমেই সাফল্য লাভ করেছে। যুগের সঙ্গে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমাদের জীবনযাত্রা গতিশীল হলেও দুঃখের বিষয় হলো গবেষণায় আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হতো। সময়ের বিবর্তনে ক্রমেই যেন সেই ঐতিহ্য সংকুচিত হয়ে আসছে। অথচ ছাত্র শিক্ষক, ভৌত অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত না হলেও তিনগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় শিক্ষার গুণগত মান এবং গবেষণার ক্ষেত্র, পরিমাণ ও মান কতটুকু বেড়েছে বা কমেছে সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে। গবেষণার বিষয়ে গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রচারিত হয় তা দেখলে বা শুনলে অনেক সময় আচার্য হিসেবে আমাকেও লজ্জায় পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক, আর তা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
আবদুল হামিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি আমার আহ্বান আপনারা শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলুন, যাতে তাদের এজন্য বিদেশে পাড়ি দিতে না হয়। আপনারা তরুণ গবেষকদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসুন।
তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রযুক্তি আর আধুনিকতায় অনেক এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কর্মঠ আর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগেও প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে, ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট উত্তোলন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ছাত্র-ছাত্রীরা অবহেলা আর হয়রানির মুখোমুখি হন। আমি শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে One Stop Service Center, Counselling and Support Center, Career Planning Unit ইত্যাদি চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।
‘পাশাপাশি আমি সেশনজট কমানোর উদ্যোগ হিসেবে Loss Recovery Plan, গবেষণা-প্রকাশনা মেলা আয়োজন এবং Student Promotion & Support Unit চালু করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, সমাবর্তন যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। কেননা সমাবর্তনের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন স্বীকৃতি লাভ করে তাদের মেধা ও প্রতিভার, তেমনি সচেতন হয়ে ওঠে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে। তাদের সুনাগরিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতার যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা সর্বজনস্বীকৃত।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তবে তোমাদের শিক্ষার্জন যেন সমাবর্তন আর সার্টিফিকেটেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তোমাদের আজকের এই অর্জনের পেছনে বাবা-মা, শিক্ষক এবং রাষ্ট্রের যে অবদান ও ত্যাগ রয়েছে, তা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, আসুন আমরা সবাই প্রগতি, আধুনিকতা ও সহনশীলতার দিকে আরও বেশি এগিয়ে যাই। সব ধরনের সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতা থেকে নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের মুক্ত রাখি। সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অধিকতর কার্যকর অবদান রাখবেন- এটাই আমার প্রত্যাশা।