মোঃ এমদাদ উল্যাহ,পিবিএ: বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠিই তরুণ। তরুণরাই উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রকৃত কারিগর। তামাকাসক্ত তরুণ সমাজ এই স্বপ্ন পূরণে অবদান রাখতে পারবে না বরং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনই পারে তরুণদের তামাকের ছোবল থেকে সুরক্ষা দিতে।
জানা গেছে, বর্তমানে আমাদের দেশে ছোট বড় সব ধরণের দোকানে অর্থাৎ মুদি দোকান থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে। তামাক এমন একটি দ্রব্য যার ক্ষতির মাত্রা খুবই ভয়াবহ। গবেষণা অনুযায়ী, তামাকের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৮০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই ১ লাখ ২৬ হাজার। দেশের প্রতি বছর তামাকজাতদ্রব্য সেবনের কারণে ফুসফুসে-মুখগহ্বরের ক্যান্সার, হৃদরোগ ও হাঁপানিসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতি রোগে ১২ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রতি বছর ১২ আগস্ট পালিত হয় আন্তর্জাতিক যুব দিবস। বাংলাদেশের জন্য দিবসটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষ্যে তরুণ ও যুব সমাজকে তামাকমুক্ত রাখতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছে তামাকবিরোধী গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)।
টোব্যাকো অ্যাটলাস এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী; বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৭২ হাজারের বেশি। অল্প বয়সে তামাকপণ্যে আসক্ত হয়ে পড়লে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ফুসফুসের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ, অকাল বার্ধক্য, মানসিক অস্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ রোগ সৃষ্টি হয় তামাকের কারণে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, যারা কিশোর বয়সে ধূমপানে আসক্ত হয়, তাদের অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় তিন গুণ বেশি এবং কোকেইনের ক্ষেত্রে ২২ গুণ বেশি। অর্থাৎ তামাক ও নিকোটিন কেবল একটি আসক্তিই নয়, এটি তরুণদের আরো অনেক বিধ্বংসী আসক্তির পথে পরিচালিত করে। তরুণদের সুরক্ষায় আইনের সংশোধনীতে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, বিড়ি-সিগারেটের সিঙ্গেল স্টিক বা খুচরা শলাকা বিক্রয় নিষিদ্ধ, ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি) এর মতো ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসমূহ আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ, তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বাড়িয়ে ৯০% এবং পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত প্রভৃতি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বর্তমানে দেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে যে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তার কারণে প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকারদের সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন পাশ ও বিধিমালা জারি করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীর তুলনায় একজন ধূমপায়ী বেশি মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। তাদের কে বুঝাতে হবে ধূমপানের ফলে মানসিক চাপ আস্তে আস্তে বাড়ে এবং ধূমপান পরিত্যাগ করার পর তা ক্রমশ হ্রাস পায়। মানসিক চাপ কমানোর জন্য-গান শোনা, ব্যায়াম করা, খেলাধুলা করা বা বই পড়ার অভ্যাস করা যেতে পারে, যা মানসিক অস্থিরতা কমাবে এবং ধুমপানের আসক্তি থেকে মুক্তি দিবে।
তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে ও বিপণনের জন্য দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই এবং ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এর বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রণয়ন করে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তামাক উৎপাদন থেকে শুরু করে সেবন পর্যন্ত সবাই আর্থিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে তামাক মানুষের মস্তিষ্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। মানুষের স্মৃতিশক্তি ও বোধশক্তি দুটিই কমে যেতে পারে। কিশোর বয়সীদের স্মৃতিশক্তি ও বোধশক্তি কমিয়ে দেয়। এমনকি মস্তিষ্ক ছোট হয়েও যেতে পারে। তামাকের কু-প্রভাবে জাতিকে রক্ষা করতে হলে ব্যাপক সচেতনতা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কার্যকর করা দরকার। তামাকের গ্রাস থেকে মুক্ত হতে সরাকরের পাশাপাশি সকল নাগরিকের সচেতন হতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে তামাক ছাড়ার চেষ্টা করতে হবে।
এছাড়াও তরুণদের উচিত-গ্রাম, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য সভা, সমাবেশ করে মানুষকে সচেতন করে তোলা। অর্থ্যাৎ তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। তাহলে গ্রামাঞ্চল থেকেই মানুষ তামাকের বিরুদ্ধে সচেতন হবে। এতে করে প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত গড়ে তোলার চেষ্টা সফল হবে।
এক প্রতিক্রিয়ায় প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে তামাক একটি বড় বাধা। তরুণ সমাজকে তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে আরো শক্তিশালী এবং যুগোপযোগী করতে হবে’।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, ‘আজকের তরুণরাই আগামী দিনে জাতির নেতৃত্ব দিবে। এজন্য তরুণদের তামাকাসক্ত থেকে ফিরিয়ে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে হবে। সর্বোপরি প্রত্যেকে স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। কারণ সুস্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’।