তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে অন্তরায় তামাক--০২

ধূমপানে মানবদেহে যে সব ক্ষতি

মোঃ এমদাদ উল্যাহ,পিবিএ: জীবন অদ্ভুত সুন্দর। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অনন্য সৃষ্টিকে বিশুদ্ধ চিত্তে উপভোগ করা উচিত। মাঝখান থেকে ধূমপান, নিকোটিন আসক্তিতে ডুবে গিয়ে বিভ্রমে জগত দেখার কোন অর্থ নেই। শরীর নিজের বলে, যা ইচ্ছে-তাই গ্রহণে তার সর্বনাশ করে শুধু বিপদই আসে। জীবনে ডিপ্রশান, হতাশা, ব্যর্থতা, বিতৃষ্ণা আসা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তামাক ব্যবহারের ফলে হ্রদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। যা প্রাকারান্তরে স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়ভার বৃদ্ধি, অকালমৃত্যু, জীবনে সুস্থ- সময় এর মেয়াদ হ্রাস ও উৎপাদনশীলতা বিনাশের মাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির উদ্যোগে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও ক্যান্সার রিসার্চ-ইউকে এর সহোযোগিতায় স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণায় জানা গেছে, তামাকে প্রায় ৭০০০ প্রকারের রাসায়নিক আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; ফরমালডিহাইড, সায়নাইড, আর্সেনিক, কার্বন- মনোক্সাইড অন্যতম। ধূমপানের ফলে এই ক্ষতিকর রাসায়নিক ফুসফুস থেকে রক্তে পৌঁছে। রক্তের অণুচক্রিকাকে এক সাথে লেগে থাকার বা যুক্ত হবার ইন্ধন দেয়। প্ররোচণার তোড়জোড়ে অণুচক্রিকা জমাট হতে শুরু করে। তামাকজাত দ্রব্য সেবনে মুখ, গলায় ও ফুসফুসে ক্যান্সার, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, স্ট্রোক, হৃদরোগ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি, মানুষের বয়স বাড়লে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে তা বেশ আগেই দেখা দেয়। বেশ কিছু স্নায়ুবিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে; বিভ্রম, আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, উদ্বিগ্নতা, হ্যালুসিনেশান, হতাশা, ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন। তামাক মূলত হৃৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।

নিকোটিন ছাড়াও সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নানা ক্ষতিকর রাসায়ানিকের প্রভাবে মস্তিষ্কের বাইরের দিকের স্তর কর্টেক্স ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। এডিনবার্গ ও ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক সমীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছেন। প্রায় ৫৫০ জন ধূমপায়ীর মস্তিষ্কের এমআরআই করে দেখা গেছে, অধুমপায়ীদের তুলনায় তাঁদের গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে। প্রসঙ্গত; সেরিব্রাল কর্টেক্স অর্থাৎ মস্তিষ্কের বাইরের স্তর মোট মস্তিষ্কের দুই তৃতীয়াংশ এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিগারেটের ধোঁয়ার ক্ষতিকর রাসায়ানিকের প্রভাবে ব্রেনের গ্রে সেল ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। কর্টেক্স বা গ্রে ম্যাটার ব্রেনের সব থেকে উন্নত অংশ। এই অংশই আমাদের বুদ্ধি, ভাবনা চিন্তার শক্তি, কথা বলা ও বোঝা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা-সহ বিভিন্ন মানসিক বিকাশের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এ অংশের ক্ষয় হলে সামগ্রিক ভাবে বুদ্ধি যায় কমে।

গবেষণা আরও বলছে, দেশে প্রতি চার জনের একজনই তামাকে আসক্ত। আর বড়দের ধূমপানের কারণে আক্রান্ত ৬১ হাজার শিশু। পরোক্ষ ধুমপানের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত তারা। তামাকজনিত ব্যাধি ও অকাল মৃত্যুর কারণে প্রতিবছর ৩০ হাজার কোটি ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৮ সালেই মৃত্যুর হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার জন। ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক শতাংশ ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে, যাদের সংখ্যা তিন কোটি ৭৭ লাখ।

গবেষণা সূত্রে আরও জানা গেছে, ধূমপায়ী পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়। শুক্রাণুর বিকৃত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। একই সঙ্গে পুরুষত্বহীনতা ডেকে আনতে পারে। পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ ধূমপান। মেয়েদের মা হওয়ার ক্ষমতা কমায় ধূমপান। মেন্সট্রুয়াল সাইকেল এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। মেনোপজ এগিয়ে আসে। সার্ভিক্স-সহ অন্যান্য ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ে। শ্বাসনালী আর ফুসফুসের সব থেকে বেশি ক্ষতি করে সিগারেটের ধোঁয়া। শ্বাসনালীর ওপরের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্দি, হাঁচি, কাশির পাশাপাশি বার বার শ্বাসনালীর সংক্রমণ হয়। তামাক আর ক্যান্সার প্রায় সমার্থক। নাক, কান, গলা, মুখের মধ্যে ও জিভের ক্যান্সারের সঙ্গে সঙ্গে গলা, স্বরযন্ত্র, ফুসফুস ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ তামাক। ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে। রক্তচাপ ও হার্ট রেট বেড়ে যায় তামাক সেবনে। রক্তনালীর সংকোচনের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। একই সঙ্গে রক্ত অতিরিক্ত চটচটে হয়ে যাওয়ায় জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ে। ফলস্বরূপ হার্ট অ্যাটাক হয় ও মস্তিষ্কে সমস্যা হয়। ধূমপান নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই। চোখের নানা সমস্যা-সহ অন্ধত্বের আশঙ্কা বাড়ে। মাড়ি ও দাঁতের অসুখের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, ‘তামাকের কারণে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। শরীরের নানাবিধ সমস্যা থেকে বাঁচতে প্রত্যেকে তামাকমুক্ত থাকা ও অপরকে তামাকমুক্ত থাকতে পরামর্শ দেওয়া উচিত’।

 

 

 

আরও পড়ুন...