
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, উত্তরাঞ্চলের তিস্তাপাড়ের পানিবঞ্চিত মানুষেরা আজ সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চায় যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ৫৪টি অভিন্ন নদী, এসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি কারও করুণার বিষয় নয়। এটা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য, এটি বাংলাদেশের মানুষের প্রাপ্য। অথচ আমরা দেখছি, আন্তর্জাতিক তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য আজকে আমাদেরকে আন্দোলন করতে হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের টানা ৪৮ ঘণ্টার ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচির সমাপনী জনসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে সোমবার থেকে রংপুরের পাঁচ জেলার ১১টি পয়েন্টে এই কর্মসূচি পালন করছেন তিস্তাপাড়ের সর্বস্তরের মানুষ।
ভারতের বৈষম্যমূলক আচরণ প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে অপ্রতিবেশীমূলক আচরণ করেই চলেছে। আপনাদের সকলের জানা আছে, আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর হলো ফারাক্কার অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পায়নি। এখন আবার তিস্তা বাংলাদেশের জন্য আরেকটি অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আমাদের প্রতিবেশী উজানের গজলডোবায় একটি বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাদের এই অপ্রতিবেশীমূলক আচরণের কারণে আজকে উত্তরাঞ্চলের লাখো-কোটি জনগণ বন্যায় খরায় দুর্বিষহ জীবন পার করছে।
তিনি আরও বলেন, পানির অভাবে তিস্তার বুকে আজকে ধূধূ বালুচর। একদিকে পানির অভাবে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল। আবার কখনো হঠাৎ করেই উজান থেকে ছেড়ে দিচ্ছে পানি, দুদিন আগে যেমনটা হয়েছে। আর সেই পানির কারণে বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি। কৃষকের আবাদি ফসল ভাসিয়ে দিচ্ছে। এমনকি বছরে তিনবারও বন্যা হয়েছে এই অঞ্চলে। প্রত্যেক বছর বন্যার কারণে নদীভাঙন হচ্ছে। শস্যের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে লক্ষ-কোটি টাকা।
শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানো প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ৫ আগস্ট এই দেশ থেকে একজন পালিয়ে গেছে। একটা খুনি এই দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। স্বৈরাচার এই দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। এই স্বৈরাচার একটা কথা বলেছিল_‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারাজীবন মনে রাখবে’। এই ভারত শুধু পলাতক স্বৈরাচারকেই মনে রেখেছে বাংলাদেশের জনগণকে তারা মনে রাখেনি। পলাতক স্বৈরাচারকে আশ্রয় দেওয়া ছাড়া ভারত বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সারা বিশ্বজুড়ে সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা, সমাধান কিংবা পারস্পরিক স্বার্থ জড়িত থাকে। নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করে প্রতিটি দেশই কিন্তু সমস্যার সমাধানগুলো নিরসন করে। এটিই হচ্ছে কূটনৈতিক রীতি। পলাতক খুনি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা জোর করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে গিয়ে নিজেকে সে তাদের (ভারতের) সেবাদাসীতে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর রেখেছিল।
তারেক রহমান বলেন, সারা দেশের মানুষ জানে এখনো ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাজমান ফারাক্কার সমস্যার সমাধান হয়নি। উত্তরাঞ্চলের জনগণের বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তিও হয়নি। অথচ সকল আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে পলাতক খুনি স্বৈরাচার প্রতিবেশী দেশকে ট্রানজিট শিপমেন্টের বন্দর ব্যবহারে একতরফা সুবিধা দিয়ে গেছে। এসব চুক্তিতে ন্যূনতম ন্যায্যতা পর্যন্ত রক্ষা করা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রয়োজনে সকল অসম অন্যায্য এবং একতরফা যেসব চুক্তি রয়েছে তার পুনর্মূল্যায়ন কিংবা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এটি হচ্ছে মূল স্লোগান বা মূল নীতি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এই নীতিটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
বর্তমান বিশ্বে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি দেশের সঙ্গে অপর দেশের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা, ন্যায্যতা এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে। সুতরাং সম্পর্ক রক্ষা করার ক্ষেত্রে নিজ দেশের এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষাই হতে হবে প্রথম এবং প্রধান অগ্রাধিকার। এ কারণে বিএনপির স্লোগান ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ আর কাঁটাতারের ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ দেখতে চায় না। সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের রক্তাক্ত মরদেহ আর বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায় না।
তারেক রহমান বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয় বা দিতে যদি দেরি করে, তিস্তা চুক্তি করতে অনীহা দেখায় তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে জনগণকে বাঁচাতে, কৃষিকে বাঁচাতে, কৃষককে বাঁচাতে, নদী বাঁচাতে, নাব্যতা রক্ষা করতে তিস্তা সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদেরকেই আমাদের বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সকল সম্ভাব্য বিকল্পকে কাজে লাগাতে হবে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সকল আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালোভাবে বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও আমাদেরকে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা শুরু করতে হবে। আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে আর সময়ক্ষেপণ না করে বাংলাদেশকে ১৯৯২ সালের ওয়াটার কনভেনশন এবং ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণ থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জনগণের সমর্থনে আল্লাহর রহমতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আগামী দিনে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সবরকম উদ্যোগ আমরা ইনশাআল্লাহ গ্রহণ করব। পাশাপাশি বর্ষাসহ অন্য অন্য উৎস থেকে পানি সংরক্ষণ করে রাখার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে থাকা তিস্তার ডান পাশের সাতটি নদী এবং বাম পাশের পাঁচটি শাখা বা উপনদী খনন করতে হবে আমাদের। এ ছাড়াও পানির বিকল্প উৎস তৈরি এবং পানি সংরক্ষণের জন্য নদী ও পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাধার নির্মাণ এবং পুনরায় শহীদ জিয়ার সেই খাল খনন কর্মসূচি চালু করব ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, দেশের জনগণের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মানবাধিকার কেড়ে নিয়ে ভোটের অধিকার ডাকাতি করে পলাতক স্বৈরাচার দেশে মাফিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। পলাতক খুনি স্বৈরাচারের আমলে জাতীয় নির্বাচনকে তামাশার বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। জনগণকে বিগত ১৫টি বছর ভোট দিয়ে সংসদ সরকার অর্থাৎ জনগণের নিজের সরকার প্রতিষ্ঠা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট মাফিয়া খুনি স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ এবং সম্ভাবনা আবার তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ।
তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি কিংবা সরকারের কোনো হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে যাতে খুনি পলাতক স্বৈরাচার আর তার দোসররা পুনর্বাসনের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। অতীতের মতো সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের কথা শুনলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কেউ কেউ বিচলিত হয়ে ওঠেন। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একেক উপদেষ্টা একেক রকমের বক্তব্য খুনি মাফিয়া চক্রের সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ সুগম করে দেয়। এজন্যই বিএনপি বারবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের কর্মপরিকল্পনা রোডম্যাপ ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে সমর্থন ও ভোট দিতে তিস্তাপাড়ের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, তিস্তাপাড়ের ভাই-বোনেরা দুই দিন ধরে তিস্তার ১১টি পয়েন্টে আপনারা যে দাবি নিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন, আপনাদের এই আন্দোলন অবশ্যই বৃথা যাবে না, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে ইনশাআল্লাহ।
‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে দুদিনের এ কর্মসূচির সমাপনী দিনে জনতার গণসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা নদী বেষ্টিত লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার মানুষ তিস্তা নদীর পানি বৈষম্যের শিকার হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা বাকস্বাধীনতা পেয়েছি। রংপুরের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে জেগে উঠেছে। এ লক্ষ্যে তিস্তা নদীর পানি চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে ৫ জেলার মানুষকে নিয়ে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তিস্তা পানি নিয়ে বৈষম্যের বিষয়টি গোটা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া হবে। যদি আমাদের দাবি আদায় না হয় তাহলে পুরো উত্তরাঞ্চল অচল করে দেওয়ার মতো বৃহত্তর কর্মসূচি আগামীতে ঘোষণা করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এর আগে সকালে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে গণপদযাত্রা শুরু করে তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কমিটি। এ পদযাত্রায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীসহ তিস্তাপাড়ের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছেন। গণপদযাত্রাটি লালমনিরহাট প্রান্তের তিস্তা ব্রিজ থেকে শুরু হয়ে রংপুরের কাউনিয়া বাজার প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়।
তিস্তা বিস্তৃত রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের ১১টি পয়েন্টে স্মরণকালের এই বৃহৎ কর্মসূচিতে যোগ দেন সর্বস্তরের কয়েক লাখ মানুষ। প্রথম দিনের মতো মঙ্গলবার সমাপনী দিনেও সকাল থেকেই ১১টি পয়েন্টে জনতার সমাবেশ, গণপদযাত্রা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিল। সেইসঙ্গে নদীর পানিতে দাঁড়িয়ে অভিনব প্রতিবাদ ছাড়াও দেশীয় সংগীত, নৃত্য, খেলাধুলা চলে দুদিনের আয়োজন ঘিরে।
এদিকে সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া ৪৮ ঘণ্টা লাগাতার অবস্থান, জনতার গণসমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুদিনের এ কর্মসূচিতে ১১টি পয়েন্টে কয়েক লাখ মানুষের জনস্রোতে উত্তাল ছিল তিস্তা বাঁচানোর দাবি। এতে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সংহতি জানিয়ে সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।