ইসাহাক আলী: ‘ঈদ’ সে তো আনন্দের এ যেন ধ্রুবতারার মত সত্য হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। আপন হৃদয়গুলো উল্লাসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ঈদ আসলে। তবুও কখনো কখনো এই ইদের আনন্দ উপভোগের চেয়ে উপলব্ধিটাই বড্ড বেশি হয়ে ওঠে।
সারা বিশ্বে করোনা মাহামারীর ভয়াল ছোঁয়ার সাক্ষী হতে হয়েছে প্রিয় বাংলাদেশকেও। করোনার প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি এই মাতৃভূমির কোনো পথ-ঘাট। করোনা আক্রান্ত রোগী এখন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেই পাওয়া যায়। আর প্রিয় জন্মভুমির এই ক্লান্তিলগ্নে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিতে ভুলেনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীববিজ্ঞান বিভাগ পরিবার।
বাংলাদেশের প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের কাজ শুরু করে। আর এই কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে ছোট ছোট গ্রুপ করেই এগিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা শনাক্তকরণের কাজ। দেশের প্রয়োজনে ঈদের সময়ও থেমে যায়নি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ কাজ।
এবার ঈদের সময় করোনা শনাক্তকরণ স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপে জায়গা হয়েছে আমাদের কয়েকজনের। তবে ইদে আর বাড়ি ফেরা হবেনা জেনেই এই কাজে যুক্ত হয়েছে এই গ্রুপের প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবক।
পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে চায়না এমন মানুষ কখনো চোখে পড়েনি আমার। অনেক বেশি ভাড়া গুনে আর সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেও রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর সাথে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করার দৃশ্য নজর কেড়েছে সহস্রবার।
তবে দেশের অসহায় মানুষগুলোর মানবতার জীবন স্মরন হলে ঈদে বাড়ি যেতেই হবে এমন ইচ্ছাটা বুঝি অনায়াসেই হারিয়ে গেছে গ্রুপের প্রতিটি সদস্যের। সবার পরিবার থেকেই চায় যেকোন ভাবেই বাড়ি যেতে হবে ঈদে। পারিবারিক বন্ধনে এই সব ঘটনা হয়তো মামুলি কোন ব্যাপারমাত্র।
করোনা পরীক্ষণ এই স্বেচ্ছাসেবক দলের দু একজন তো বাবা-মায়ের একমাত্র নয়নের মণি। কেউ আবার বাবা-মায়ের সবচেয়ে বড় কর্ণধর। তাই বুঝি সন্তান ছাড়া বাবা-মায়ের ইদ কেবল অপূর্ণতাই ভরে থাকে না, বিষাদের উপাখ্যানে পরিণত হয়।
করোনা সনাক্তকরণের কাজে নিয়মিতদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার হয়েছেন এই করোনার ভয়াল থাবার। সরাসরি ভাইরাসটা নিয়ে কাজ করার সুবাদে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অন্য সবার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে এই শনাক্তকরণ সদস্যদের। তাই পারিবারিক পিছুটান হয়তো প্রকৃতিরই নিয়মের অংশ হয়ে থাকে।
সেদিন একজনের বাবা ছেলেকে ছাড়া ঈদ করতে হবে শুনে হতভম্ভ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, “তুমি না আসলে কাকে নিয়ে ঈদ করবো, বাবা”।
একটু দৃঢ়তার সাথে ছেলে বলেছিল, “দেশের জন্যে এটুকুতো করতেই হবে বাবা। আমি না থাকলে তো অন্য কোন বাবার মায়ায় জড়ানো কোন সন্তানকে শামিল হতে হত এই ত্যাগের মোহনায়।” তারপর সেই বাবা আর কোনদিন ঈদে ছেলেকে বাড়ি ডাকেনি। হয়তো বাস্তবতার কাছে নিজেকে সপে দিয়েছে সে বাবাও।
আর একজন তার বাবাকে বলে এসেছিল, তিন দিন পরেই চলে আসবো বাবা। সেই বাবা প্রতিদিন আফসোস করে বলে যে তুমি তিন দিন বলে গেলে আর এখনও……..! সেও জানতো যে সাজিয়ে গুছিয়ে এই মিথ্যাটা না বললে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এমন কাজে অংশগ্রহনে হয়তো সুযোগ হতো না তারও।
এই স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিটি সদস্যেরই কানে ভাসছে হৃদয় ভাঙ্গার এমন যতসব কথোপকথন। প্রতিটি অন্তরে পড়ে আছে বিষাদের ছায়া। প্রিয় মানুষদের সাথে ঈদের আনন্দঘন মুহূর্তের দৃশ্যটা হৃদয়পটে উকি দেয় বারে বার।কিন্তু প্রিয় ঠিকানার এই প্রিয় মানুষদের অশ্রুসিক্ত নয়নে আশা জাগাতে এই নিরন্তর পথ চলা আমাদের। দেশের তরে আমাদের এই তুচ্ছ আয়োজনে অট্টহাসিতে মেতেছি সবাই। নিমিষেই ভুলে গেছি ঐ মায়ার বান্ধনের যতসব পিছুটান।
আবার পৃথিবী মুক্ত হোক। মুক্ত বাতাসে ছুটে চলুক নিষ্পাপ স্বপ্নগুলো। লাল-নীল আলোয় ইট-পাথরের শহরটা আবার হয়ে উঠুক ব্যস্তময়। নিরন্তর ছুটে চলা মানুষগুলো এগিয়ে নিয়ে যাক প্রিয় মাতৃভূমি এই সোনার বাংলাকে। আবার ঈদের মাঠ ভরে উঠুক প্রিয় মানুষদের কোলাহলে। দুঃখ-বেদনা শেষ হয়ে ইদ হয়ে উঠুক আনন্দ-উল্লাসের। আজ শুধু সেই প্রতীক্ষা।
লেখক, করোনা পরীক্ষণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য
ও শিক্ষার্থী অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
পিবিএ/মোসাব্বির হোসাইন/এমআর