তুমি মেয়ে মানুষ এত কথা বল কেন?

মারিয়া সালাম: ঘটনা ১: ১৯৯৯ বা ২০০০ সাল হবে। কয়েকজন বন্ধু মিলে পদ্মার পাড়ে বেড়াতে গেছি। আমরা নৌকায় উঠে তখন মাঝ নদীতে, এমন সময় কয়েকজন স্থানীয় যুবক ঘাটে আসল। তারাও একটা নৌকা ভাড়া করলো, বিপত্তি হলো যখন নৌকায় উঠতে গিয়ে একজন পানিতে পড়ে গেল। আমাদের সাথের এক বান্ধবী সেটা দেখে খুব শব্দ করে হেসে উঠলো।
আমরা পাড়ে নামতেই, ওরা এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। একজন আমাদের সেই বান্ধবীকে বলল, শালী, খুব মজা নিস না? কাপড় খুলে ছেড়ে দিলে বুঝবি মজা কাকে বলে। আমার সাথে থাকা দুই বান্ধবী, গালি খাওয়া মেয়েটি সহ, আর দুই বন্ধু মুখ বন্ধ করে হাঁটতে থাকলো। আমি হতবাক হয়ে গেলাম, প্রথমত আমি নিজেই স্থানীয়। আমাদের পরিবার এলাকায় রাজনৈতিকভাবে বেশ প্রভাবশালী ছিল বিধায় এরকম কথাবার্তা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস কারো ছিল না। দ্বিতীয়ত, এরকম কথা শুনে মুখ বন্ধ করে মানুষ কিভাবে চলে যেতে পারে!

আমিই আগ বেড়ে বললাম, এই আপনারা বাজে কথা বলবেন না। বলতেই চার, পাঁচজন ছেলে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসল, তুমুল কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমার বন্ধুরা ততক্ষণে বেশ দূরে চলে গেছে, সেই সুযোগে দলটা আমাকে ঘিরে ধরেছে। চারদিকে অসংখ্য মানুষ জুটে গেছে। ছেলেগুলো আমাকে তেড়ে তেড়ে মারতে আসছে আর সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। এক বৃদ্ধ চাচা এসে বলল, তুমি মেয়ে মানুষ এত কথা বল কেন? মুখ বন্ধ করে চলে গেলেই পার।

অনেকেই সেই ছেলেগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে, মেয়ে মানুষ হয়ে এত কথা কিসের, কিসের জোর দেখাচ্ছে এই মেয়ে? আমি বললাম, আমি কিসের জোর দেখাচ্ছি? তোরা চিনিস আমি কে? কোন বাড়ির মেয়ে? বলতেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে, সেই বখাটেদের মধ্যে একজনের কানে কানে কি যেন বলল, সম্ভবত আমার পরিচয়।

সাথে সাথেই ছেলেগুলো আমাকে ছেড়ে স্রেফ গায়েব হয়ে গেল। আমি সাথে সাথে একটা দোকান থেকে বাড়িতে ল্যান্ডফোনে কল দিলাম, পাঁচ মিনিটে আমার মামারা এসে হাজির। অনেক খোঁজ করা হলো, সেই বখাটেদের আর পাওয়া গেল না, এমনকি এলাকার কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারলো না।

ঘটনা ২: ২০১৪ সাল। আমরা কয়েকজন অফিস থেকে মাইক্রোবাসে করে প্রতিদিন বাড়ি ফিরি। পথে আগারগাঁওয়ে একজন নারী সহকর্মীকে নামিয়ে আমরা মিরপুর আসি। বিকাল ৪ টা হবে, আমরা প্রতিদিনের মতো আগারগাঁওয়ে থামলাম। আমার সহকর্মীটি নামতেই কয়েকজন ছেলে তাকে লক্ষ্য করে খুব বাজে কথা বলে বসলো। আমি গাড়ি থেকে মুখ বের করে বললাম, এই ছেলে বাজে কথা বলছ কেন?

বলা মাত্র সেই ছেলেগুলো আমাকে আর আমার অরেক পুরুষ সহকর্মীকে যাতা বাজে গালাগাল করতে লাগলো। ততক্ষণে সেই নারী সহকর্মীকে একটা রিকশা ডেকে আমরা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমরা এলাকা ছাড়তে পারছি না, ঐ ছেলেগুলো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি আটকে দিয়েছে। আমাদের নাকি যেতে দিবে না, আমরা গাড়ি থেকে নামলেই পিটাবে।

আমি আগারগাঁও থানায় একটা কল দিলাম, ওসি সাহেব বললেন, আপা আমি দশ মিনিটেই লোক পাঠাচ্ছি। এরমধ্যেই এক ছেলে তার প্যান্টের চেইন খুলে আমাকে বাজে ইঙ্গিত করতে শুরু করেছে। আমি অনেক সাহস করে গাড়ি থেকে নামলাম, বললাম, নে শুয়োরের বাচ্চারা এবার আটকা। আমি কথাটা বলতে না বলতেই, একজন পকেট থেকে ক্ষুর বের করলো।

আমি তখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। সেটা দেখেই কিনা জানি না, ছেলেগুলো একটু পিছিয়ে গেল। আমি আরো এগিয়ে গেলাম, তারা উল্টা ঘুরে হাঁটা শুরু করেছে। আমি দ্রুত হেঁটেও ওদের সাথে পেরে উঠলাম না, ওরা একটা বাসে উঠে গেল। প্রায় সাথে সাথেই পুলিশ এসে গেল, অনেক চেষ্টা করেও ওদের পরিচয় জানা গেল না। সেদিনও রাস্তায় বহুলোক জড়ো হয়েছিল, কিন্তু কেউ কিছু বলে নি। এমনকি পুলিশকে সেই ছেলেগুলোর পরিচয়ও বলে নি, অথচ স্থানীয় না হলে কেউ মিডিয়ার গাড়ি আটকানোর সাহস করবে না।

এই রকম আরো অনেক ঘটনা আমি নিজে ফেস করেছি। আমি দেখেছি, এসব ক্ষেত্রে স্থানীয়রা কেবল দর্শক হয়ে ঘটনা দেখে, কিচ্ছুটি বলে না। অথচ আমরা প্রায় দেখি, অসামাজিক কাজ করতে গিয়ে অমুকে হাতে নাতে স্থানীয়দের হাতে ধরা খেয়েছে, এই শিরোনামে খবর আসে। আচ্ছা, লোকে যখন বিপদে পড়ে এই উদ্যমী জনতা কোথায় থাকে? তবে কি জনসম্মুখে নারী নিগ্রহ করার চেয়ে গোপনে কোন নারীর সাথে সময় কাটানো অনেক বড় অপরাধ?

আজ কবি রবীন্দ্র গোপ এরকম একটা ধরা খেয়েছে, সে বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই। তাকে সমর্থন করছি না। দুইজন মানুষের মধ্যে কি হবে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু ব্যক্তিগত কিছু দপ্তরে করাটা ঠিক না।

আমার প্রশ্ন যখন জনসম্মুখে মানুষ বিপদে পড়ে তখন এই সমাজের উদ্ধারকর্তা স্থানীয় জনতা কোথায় থাকে?

লেখক: লেখক ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন...