মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম (বার),
পুলিশ সুপার, সাতক্ষীরা : সারা পৃথিবী জুড়ে আতংক সৃষ্টি করা ঘাতকের নাম করোনা ভাইরাস। মানুষের সাধারন ধারনা ছিল বাঘ, ভাল্লুক তাড়া করলে ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বাসায় ঢুকে আত্নরক্ষা করবে। কিন্তু না এটি এমন এক শত্রু যা দেখা যায় না খালি চোখে। অথচ তারই ভয়ে সবাই মারাত্মকভাবে ভীত। অনেকটা মিষ্টার ইন্ডিয়া সিনেমার অনীল কাপুরের অদৃশ্যে থেকে ভিলেন অমরেশপুরি আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের শায়েস্তা করার মত। আমরা কেউ খালি চোখে এ ঘাতককে দেখছি না অথচ একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে।
আজ ১৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫৪ হাজার মানুষ মারা গেলেন এ নীরব ভয়ংকর ঘাতকের আক্রমণে। আক্রান্ত ২২ লাখ ৪২ হাজার। বাংলাদেশে ইতমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ৮৪। আর আক্রান্ত ২ হাজার ১৪৪ জন। আক্রান্ত সংখ্যা হিসাবে মৃতের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশী।
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ দুনিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। পার্বত্য এলাকার আয়তন আর জনসংখ্যা বাদ দিয়ে বাকী ভূমি আর জনসংখ্যা দিয়ে বিভাজন করলে এ জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে গ্রীনিচ বুকে লিখে রাখার মত। আর নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী সমূহের আয়তনকে কল্পনায় বাহিরে রেখে ভাবলে আমাদের দেশের ঘনত্ব অকল্পনীয়।
এবার আসি, মূল প্রসঙ্গ ত্রাণ……
বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ করোনা মহামারীতে করোনাকে ছাড়িয়ে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ত্রাণ, ত্রাণ আর ত্রাণ। আমরা কতটা অসচেতন অগোছালো দায়িত্বহীন আর জাতীয়ভাবে বিশৃংঙ্খল তা বর্তমান বাংলাদেশ আর পৃথিবীর আন্যান্য দেশের তুলনামুলক চিত্র দেখলে বুঝা যায়। এই অসচেতনতা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, তা সময় বলে দিবে।
আমার সাবেক কর্মস্থল সমুহে যেখানে খুব ঘনিষ্ট অনেক মিডিয়া কর্মী রয়েছেন। অনেকের সাথে আলোচনায় জানা যায়, প্রথমদিকে লকডাউন বেশ ভালভাবে কার্যকর ছিল। আইন-শৃংখলা বাহিনী ছিল, যথেষ্ট কঠোর। কিন্তু কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারনায় পুলিশ খানিক নমনীয় হবার সুযোগে কিছু কিছু মানুষ বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।
তারপর যুক্ত হয় নতুন অধ্যায় ত্রাণ বিতরন। কখন কোথা থেকে শুরু হয়েছে এ বিতরন বলা মুশকিল। সরকারী বেসরকারী এ বিতরণে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ বনিতা বেরিয়ে আসতে থাকে। ফাঁকা রাস্তাঘাট সমুহ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। ত্রাণ গ্রহণে বেপরোয়া মানুষ এবার পুলিশ, আইন-শৃংখলা বাহিনীকেও অমান্য করার সাহসে, ফাঁকিবাজি শুরু করে। হাজার হাজার জনতা প্রতিদিন ত্রাণ খোঁজে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে রাজপথ থেকে পাড়া মহল্লা।
আবার পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবাই মাঠে নামার পর কিছু অংশ বাসায় ফিরে যায়। অনেকেই লুকোচুরি শুরু করে। পেটের ক্ষুধা থেকে ও চোখের ক্ষুধাবেড়ে যায় ফ্রি ত্রাণ পাবার আশায়। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ! ফ্রি কোন কিছু পাবার ক্ষেত্রে সারাদিন কাজ না করে কোথাও সারাদিন বসে থেকে একশত টাকা পাবে, সে আশায় বসে থাকা লোকের সংখ্যা কম নহে।
বিখ্যাত লেখক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদের “ফুড কনফারেন্স ” যারা পড়েছেন তারা জানেন রিলিফ ওয়ার্ক আর নিয়ম অনিয়মের অতীত ধারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় অসচ্ছল, পঙ্গু, বিধবা, বয়স্ক, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাভাতা, কাবিখা, কাবিটা ইত্যাদি হাজারো সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতায় রয়েছে লক্ষ লক্ষ উপকারভোগী। বর্তমানে তাৎক্ষনিক বেকার হয়ে পড়া নৃগোষ্ঠী নির্ধারিত। ছোট দোকানদার, হকার, ড্রাইভার, শ্রমজীবি ইত্যাদি সোশ্যাল সেফটি নেটের বাহিরের মানুষদের খুঁজে সহায়তা দিতে পারলে ক্রাইসিস কমে আসবে।
কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন আর বিচিত্র। আমরা কোন কিছু গ্রহনের ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে সঠিক স্থানে থাকতে পারি না। যার ফলে যাদের প্রয়োজন তারা ব্যতীত যাদের খুব প্রয়োজন নেই কিংবা আরো কিছুদিন চলবে তারাও হুজুগে সুযোগে রাস্তায় নেমে পড়েছি। এদের কেউ হয়ত প্রয়োজনে কেউ ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় নেমে পড়েছে রাস্তায়।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অতি প্রয়োজন ব্যতীতও অনেকে ত্রাণের জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামছে। যেহেতু সরকারী-বেসরকারী খাতে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতায় অনেকে রাস্তায় আসছে। যা প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।
মিডিয়ার বদৌলতে অনেক দেশের দৃশ্যের সাথে আমাদের দেশের দৃশ্যের মিল নাই। মানুষের জীবনে খাদ্যের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি বহুমাত্রিক খাদ্য তালিকার কারনে। পাশাপাশি সবুজ সুন্দর বাংলাদেশের সর্বত্র শাক-সবজি ফল-মূলের বৈচিত্রময় খাবারের ছড়াছড়ি। অর্থাৎ যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকার (সারভাইভ করা) পরিস্থিতি আমাদের দেশে অপ্রতুল নয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের সকল মানুষ এভাবে খাদ্যের ক্ষেত্রে সারভাইব করে শুধু টিকেছিল বললে ভুল হবে বরং যুদ্ধ জয় করেছিল । সে মন্ত্রটি আমাদের সবাইকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার।
যারা বলেন আমরা করোনায় মরবনা, আমরা খাওয়ায় মরব-আমি তাদের সাথে একমত নই। ভয়ংকর করোনা জীবানু খুবই বেপরোয়া। স্বাস্থ্য খাতের সেরা সেরা দেশগুলি কুপোকাত আর আমাদের পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকার হতে যাচ্ছে তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হবার দরকার নাই। যারা ভাবছেন ত্রাণ বাঁচাবে প্রাণ তাদের সতর্ক করে বলি ত্রাণ প্রাণ বাঁচার পরিবর্তে ত্রাণ-দাতা-গ্রহিতা দর্শক, প্রতিবেশী সবাই এ ভয়াবহতার শিকার হবে। এতে যে দৃশ্য মিডিয়ায় দেখছি অন্য দেশের, তা হয়ত আমাদের এখানেই সংঘঠিত হতে পারে। যদি এখনও কঠোরতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে ভয়াবহতা অনুমেয়। বিকল্প খাদ্যাভ্যাস প্রয়োগ করে ত্রাণের নামে রাস্তায় নামা বন্ধ করতে হবে।
ত্রাণে প্রাণ…..থাকবে না যাবে…..এ প্রশ্নে বলা যায় এমন ত্রাণ বিতরণে প্রাণ বাঁচবে না বরং সবার প্রাণ ঝুঁকিতে নিয়ে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিউনিটি পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রকৃত অভাবীদের তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে যারা সরকার থেকে সুবিধা পাচ্ছেন তাদের এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে হবে। সমাজের বিত্তবান, সামর্থ্যবানদের এগিয়ে এসে অভাবী প্রতিবেশীকে সাহায্য করতে হবে। সামান্য সামর্থ আর অবলম্বন থাকলেও ঝুঁকি নিয়ে বাহিরে যাওয়া যাবে না।
আমাদের মত আর্থ-সামাজিক অবস্থার দেশে বাসায় থেকে জীবন বাঁচানো থেকে আর কোন নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। এখনো পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা আর গ্রহণ ব্যবস্থার সুস্পষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে সুনিশ্চিত ভাবেই বলা যায় –
ত্রাণে প্রাণ বাঁচার বদলে নিভে যাবে মূল্যবান প্রাণ।
ঘরে থাকুন নিরাপদ থাকুন।
পিবিএ/মোহাম্মদআলম