তাসনুভা অরিন : সময়ের সাথে স্মৃতির সম্পর্ক ব্যাস্তানুপাতিক হলেও শৈশবের স্মৃতির সাথে এই সম্পর্ক সমানুপাতিক। সময় যত সামনে এগুতে থাকে শৈশবের ঋণ তত বাড়তে থাকে। বরঞ্চ বলা যায় কোন এক সময়ে মানুষ মূলত শৈশবের কাছেই ধরা দেয়। আর ধরা না দিয়েই বা যাবে কতদূর, মানুষ তো তার অবচেতনে শৈশবকে লালন করতে করতেই বড় হয়ে যায়। তার বোধের বাস্তবাতা নির্ণীত হয় শৈশব স্মৃতির এক একটি দিনের সম্মিলিত যাপনের নিজস্বতা থেকেই।
আপাতদৃষ্টিতে দন্ত্যস রওশন এর ‘ধন্যবাদ শৈশব’ শৈশবের স্মৃতিকথা মূলক বই হলেও পাঠের এক পর্যায়ে মনে হবে বাস্তবতার ভিতরে আরও একটা বাস্তবতা আছে, মনে হবে একটা গ্রাম তার শৈশব নিয়ে বলছে। লেখক এখানে তার প্রিয় বকচর গ্রামটিকে প্রকাশ করছে অথবা গ্রামটি লেখকের শৈশবকে প্রকাশ করছে। প্রকাশের এই মুখোমুখি আয়োজন পুরো বইটিকে স্মৃতি কথার আড়ালে নাগরিক আর বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকছে ।
একটি মাকড়শা যেমন জাল বুনে আড়ালে চলে যায়, বইটিতে লেখকের সরব এবং নীরব উপস্থিতি সেরকম পাঠককে গল্পের ছলে স্মৃতির জালে ফাঁসিয়ে আড়ালে চলে যায়। পাঠক এখানে দেখতে পায় তার নিজের শৈশবকে আর নিজের শৈশবকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বুকের ভিতর অনুভব করে এক ধরনের হাহাকার যেখানে কটাক্ষ নাই কিন্তু বিষণ্ণতা আছে
‘গ্রামটা ইটালি পৌঁছে গেল’ শিরোনামের প্রথম অধ্যায় থেকেই আমরা দেখতে পাবো বৈশ্বিক পরিবর্তন, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের নিঃসঙ্গতা আর মুঠোফোন আলাপন। ইছামতি নদী তীর রুপ আর আগের মতন নাই , নাই হজা ভাইএর সেই নৌকার গর্জন , লেখক খুব চমৎকারভাবে রাস্তা আর সড়কের শাব্দিক পারথক্যের ভিতর দিয়ে তুলে ধরেছেন গ্রামের শহর হয়ে ওঠার প্রয়াস আর পরিবর্তন।
দিনকে দিন প্রবাস জীবনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যাপকতা।
‘মনে মনে বলি এ কী বিস্ময়। আমাদের গ্রামটা ইতালি পৌঁছে গেছে।’
নস্টালজিয়া একধরনের সময় সমীক্ষা, বলা যায় বর্তমানের সাথে অতীতের অথবা বিস্মৃতির ভিতর থেকে আচমকা উঁকি দেয়া কোন এক মায়া মায়া পরিচিত মুখের। কিন্তু এই ইন্টারনেটের যুগে এরকম মায়া জমতে পারেনা বেশিক্ষণ। এইত কিছুদিন আগে চিঠি আর স্মৃতি ছিল একাকার আবিস্কার। এরকম বোধের গন্ধ পাওয়া যায় ‘ধন্যবাদ শৈশব’ এ যেখানে ‘ভাতের আঠায় লাগানো চিঠি’ পৌঁছে দিত মানুষের আবেগ আর অপেক্ষাকে।
দন্ত্যস রওশন এর বইটির বিষয়বস্তুর পাশাপাশি নির্মাণের দিকটিও বেশ অন্যরকম লাগলো যখন লেখক তার লেখক সত্ত্বা থেকে বের হয়ে চরিত্র সত্ত্বার সাথে তার পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিল আবদুল ওহাব সাহেবের ঘরে সাত সন্তানের জন্ম হলো। ওহাব সাহেব বলছি কেন?
আমাদের জন্ম শুরু হলো।
একটা গ্রাম কেবল একটা স্থান না বরঞ্চ তার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে সম্পর্কের গল্প, এই সম্পর্ক সাম্প্রদায়িতার উর্ধে গিয়ে এমন একটা স্থিতির কথা বলে যেখানে মানুষের সাথে মানুষের প্রেম মুখ্য, ধর্ম না।
আর শুকলাল দাদা ডাকতেন, ‘মা নক্ষী। দেখ তোর কাকা নমাজ পড়তে গেছে। ঘন্টা পরে বাজা। উলু পরে দে।’
কি আশ্চর্য ভাবেই না মানুষগুলো প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত অথচ এখন সময়, সেই সময়টাকেই খুঁজছে মিটিং মিছিল করে।
শৈশবের দিনরাত্রি একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার গল্প হলেও এইগল্পের সবটাই কিন্তু আনন্দের না, অনেক সময় দেখা যায় একটা শিশু খেলতে খেলতে এমন কিছু দুঃখের সাথে পরিচিত হয় যা তার ভিতরে জন্ম দেয় নতুন মানুষের, মনে হয় আনন্দের ভিতরে দুঃখ আর দুঃখের ভিতরে বোধ ও বোধের ভিতর লুকিয়ে থাকে অলৌকিক মানুষ অথবা নতুন মানুষ। লেখক রওশন অথবা এই গল্পের চরিত্র রওশন যখন নদী আর প্রকৃতির ভিতর একটু একটু করে বেড়ে উঠছে অবাধ চাঞ্চল্যে, নিজের ভিতরের তীরন্দাজ সত্ত্বাটা গুলতিতে এঁটেল মাটির গুলি লাগিয়ে পাখি শিকারে খুঁজে নিচ্ছে অর্জুনের বীরত্ব।
‘শকুনের দুই পাখা ধরে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম। আমাদের অত্যাচারে ধরা পড়া শকুনটা কখনো কখনো বমি করে দিত। এর শাস্তি হিসেবে লাঠি দিয়ে তাকে পিটাত ছেলেমেয়েরা’
আবার সেই চরিত্রই একদিন আবিস্কার করে তার বিপরীত চরিত্রকে যে রাজা অশোকের মত অনুতপ্ত এবং প্রেমিক।
আমাদের বড় ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়। দেখি, সেখানে একটি টুনটুনি নাচানাচি করছে। এক গুলিতেই ধুম করে পড়ে গেল মাটিতে। পরে আবিষ্কার করলাম, গাছের দুটি পাতার ভাঁজে সেটির বাসা।
কী নিষ্ঠুরতা ছিল আমার!
ক্রমান্বয়ে লেখক পরিচয় করিয়ে দেয় গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে- চৈত্র সক্রান্তি, নৌকা বাইচ , কবিগান , কলাপাতায় করে খাওয়া , বাঁশ নাচ , বৃষ্টিকে আহ্বান জানিয়ে গান এইসবই…।
তাছাড়া গ্রামীণ ঐতিহ্যে মুছলমানিকে কেন্দ্র করে যে আচার অনুষ্ঠান এবং কথোপকথন তা এই বইএ আলাদা মাত্রা দেয় ।
নৌকার মাস্তুলের মতো হয়ে রইল শিশ্ন। হঠাৎ বাইরে কোলাহল, হাসাহাসি। ‘অ্যাই, খাইয়া ফালাইলো। মুরগিডায় খাইয়া ফালাইলো। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম। কেউ একজন বলছে, ‘ওর সুনার মাথা তো মুরগিতে খাইয়া ফালাইল।’
বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্য তার প্রাকৃতিক লীলায় এতটাই পরিপূর্ণ যে সেখানে জাদুবাস্তবতাকে তৈরি করতে হয়না বরং গ্রাম বাংলার মাটি স্বয়ং এক জাদুবাস্ততা , কি উপমায় কি রহস্যে।
‘আমি হাঁটলে চাঁদও হাটেন’
শৈশব হচ্ছে কবিতার মত সময় যখন সবকিছু রঙ্গিন, এমনকি যা দেখা যায়না তাও যেমন কালবৈশাখীর সাথে কথা বলার মত আশ্চর্য নাটকীয়তাকেও সত্য মনে হয়।
তিনি জোরে জোরে বললেন, ‘আল্লাহর দোহাই। তুফান তুই দক্ষিণ দিক দিয়া চইলা যা।’
দাদার কথা শুনে দাদি বললেন, ‘কও কি তুমি। দক্ষিণে তো তোমার বড় মাইয়ার বাড়ি।’
দাদির কথা শুনে দাদা বললেন, ‘আল্লাহর দোহাই, তুফান তুই উত্তর দিক দিয়া যা।’
দাদি আবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘হায় হায়, কও কি তুমি। উত্তরে তো আমার ছোট মাইয়ার বাড়ি।’
এবার দাদা বললেন, ‘যারে তুফান যা। তোর যেদিক দিয়া খুশি সেদিক দিয়া যা।’
এভাবেই প্রকৃতির সাথে মিশতে মিশতে একটি শিশুর শৈশব যেন টুপ করে পাথরের মত ডুবে যায় আর তাকে পাওয়া যায়না । শৈশব হারানোর দুঃখ নিয়ে বড় হতে হতেই মানুষ আবার খুঁজে পায় নিজের সকল চিন্তায় চেতনায় শৈশব স্মৃতির জড়িয়ে থাকাটা যেন ‘আমি হাঁটলে চাঁদও হাটেন’।
শৈশবের কাছে মানুষের এই ঋণ না ফুরানোর ঋণ , আমৃত্যু এক ধন্যবাদ ।
দন্তস্য রওশনের এই স্মৃতিকথামূলক বই স্মৃতির উচ্ছলতা থেকে বের হয়ে এমন একটা সময়ের চিত্রধারন করে আছে যা একপ্রজন্মের কাছে জীবন্ত এবং আরেক প্রজন্মের কাছে বিস্ময় । বইটা পড়তে পড়তে পাঠক কেবল নস্টালজিয়া আক্রান্তই না বরঞ্চ তার চিন্তায় বইটি একটি আঘাত; প্রযুক্তির এগিয়ে যাওয়া এই রুপকথাময় ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে কতটা এগুতে পারে? বরঞ্চ শিকড়ের কাছাকাছি মাটির ভেজা গন্ধের মত তীব্র লাগতে পারে গ্রামে ফেরার অর্থাৎ প্রকৃতির কাছে ফেরার বাসনা ।
পিবিএ/শআ