সুমাইয়া আক্তার। মাত্র পাঁচ বছর বয়স। সুন্দরী ও হাসিখুশি শিশু সুমাইয়া সহজেই সবার মন জয় করে নেয়। এক বছর আগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তার মা আছিয়া বেগম তার বিচ্ছিন্ন প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে যান। বাবা কাশেম মিয়া বিদেশে থাকেন। অনেক দিন অপেক্ষার পর সুমাইয়ার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। শিশু সুমাইয়া তার নানীর সাথে থাকে। মা চলে যাওয়ায় বাবা বিদেশে থাকায় সুমাইয়া পিতামাতার অধিকার থেকে বঞ্চিত। ছয় মাস পর কাশেম মিয়া প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আবার বিয়ে করে নতুন স্ত্রী আছমা আক্তারকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সবাই সুমাইয়াকে শেখায় যে ঘরে তার নতুন মা এসেছে। পরদিন থেকে সুমাইয়া আছমাকে আম্মু বলে ডাকতে শুরু করে। এই কল আমার জন্য বিরক্তিকর. কারণ সে সবেমাত্র বিয়ে করেছে। এদিকে আছমাকে সুমাইয়ার দেখাশোনার জন্য আনা হলেও তার বাবা দেশে থাকাকালীন কয়েকদিন সে ভালো আচরণ করেছে। কাশেম মিয়া দুই মাস পর বিদেশে চলে যাওয়ায় সুমাইয়া এখন আরও অবহেলিত। কারণ বাড়িতে ‘নতুন বউ’ আছে ভেবে সৎ মায়ের যত্ন নিচ্ছেন না দাদি। আজকের সমাজে কেউ সৎ সন্তানকে নিজের মতো করে দেখে না। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সৎ মায়ের ‘শুধু জলে ভাত খাওয়ার’ নির্যাতনের শিকার এক শিশুর ভিডিও। এভাবে চৌদ্দগ্রামের সুমাইয়ার মতো সারাদেশে শত শত শিশু বাবা-মায়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিভিন্ন শহরের টোকাই ও পথশিশুদের অধিকাংশই তালাকপ্রাপ্ত বাবা-মায়ের সন্তান। গত এক বছরে শতাধিক তালাকপ্রাপ্ত বাবা-মায়ের সন্তানের অধিকার নিয়ে করা গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ইসলাম, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের সূত্র অনুযায়ী, সন্তানের জন্য পিতামাতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে বাবা-মায়ের কাছে শিশুরা সবচেয়ে প্রিয়। পার্থিব জীবনে সুখ-শান্তি এবং পরকালের মুক্তির অন্যতম মাধ্যম হলো নেক সন্তান। সম্পদ জীবন বাঁচানোর একটি উপায়, এবং সন্তানরা বংশ রক্ষার একটি উপায়। তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে লালন-পালন করা পিতামাতার অপরিহার্য কর্তব্য। শিশুর জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা, রোগমুক্ত, সুস্থ বিকাশ, জীবনের উন্নতি ও বিকাশের জন্য সম্ভাব্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা পিতামাতার কর্তব্য। শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু দাম্পত্য কলহের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ায় শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সমাজে যৌতুক, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিপথগামীতা, বহুবিবাহ ও কুসংস্কারের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। নারীরা যৌতুকের জন্য স্বামী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়। সমাজে যৌতুকের বলি হিসেবে মৃত্যুর ঘটনাও কম নেই। যৌতুকের দাবি বা নির্যাতনের কোনো বয়স বা সময় নেই। বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে, মহিলাদের 30 বছরের একটি পরিবার ছেড়ে যেতে দেখা যায়। এছাড়া আধুনিক যুগের ছেলে মেয়েরা একেবারেই অধৈর্য। ছোটখাটো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তারা সংসার চালাতে চায় না। হঠাৎ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন। তারা বিবেক, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না। আবার অনেক পরিবারে দেখা যায়, বিয়ের পর পরিবারের অনেকেই দম্পতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। আত্মীয়স্বজন বা অভিভাবকদের কেউ কেউ নিজেদের মতো করে দম্পতির সংসার নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এটি কখনও কখনও তিক্ততার দিকে নিয়ে যায়, যা বিবাহবিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রতিদিনই সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে ডিভোর্সের আবেদন পড়ে। ASK-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় গড়ে প্রতি ৪০ মিনিটে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। অনেকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নোটিশ আড়াল করে ৯০ দিন পর বিচ্ছেদ ঘোষণা করছেন। এ খবর পরিবার-সমাজ তথা দেশের মানুষের জন্য সুখকর হতে পারে না। স্বামী বা স্ত্রী বিদেশে বসবাসকারী; বিদেশে বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যয়বহুল তাই দেখা যায় দেশে এসে গোপনে তালাক দিয়ে একজন আরেকজনকে ধোঁকা দিচ্ছেন। অনেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এমনকি নোটারি পাবলিকের অফিসেও অবৈধ ও অনিয়মিতভাবে ‘তালাক’ দিচ্ছেন। বিয়ে ও তালাকের ডিজিটালাইজেশন না হওয়ায় প্রতারিত হচ্ছেন নারী-পুরুষ। অনলাইন বিবাহ নিবন্ধন এবং বিবাহ বিচ্ছেদ নিবন্ধন সময়ের প্রয়োজন। যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ভালো ও উপকারী।
ইউনিসেফ এবং বিবিএস 2023 এর তথ্য অনুসারে, 30.1 শতাংশ শিশু পাবলিক বা খোলা জায়গায় (যেমন রাস্তা, স্টেশন, টার্মিনাল, মাঠ বা পার্ক) বাস করে এবং ঘুমায়। এছাড়াও, রাস্তায় বসবাসকারী 82.9 শতাংশ শিশু পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে তালাকপ্রাপ্ত বাবা-মায়ের বেশিরভাগ সন্তানই ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়ে খোলামেলা বাস করে। তারা অলসতা এবং অবহেলায় বড় হয়। ফলে পথশিশুর সংখ্যা কমছে না। ইউনিসেফ 1952 সাল থেকে বাংলাদেশে শিশুদের জন্য সামাজিক নীতি, পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন, পুষ্টি, শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং সামাজিক নীতি নিয়ে কাজ করছে। ফলে সন্তানদের অধিকার সম্পর্কে অভিভাবকরা সচেতন হচ্ছেন।
লেখক: মোঃ এমদাদ উল্লাহ, সাংবাদিক-বার্তা সংস্থা পিবিএ।