জুয়েলারি শিল্পখাতের হালচাল-০৩

দুবাই থেকে প্রতিদিনই আসছে স্বর্ণ!

মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) : ১২ জুন সোমবার। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের সময় মোহাম্মদ রাসেল ইমিরেটস্ এয়ারলাইনের ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর সাথে ছিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মুন্সিরহাট এলাকার চিহ্নিত হুন্ডি ব্যবসায়ীর ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল, একটি ল্যাপটপ, একটি মোবাইল ও ২০ কেজি করে ২টি ব্যাগে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র। এগুলো বহন করে বাংলাদেশে নিয়ে আসায় তাকে টিকেট ‘ফ্রি’ দেয়া হয়েছে। একইভাবে তার আশ-পাশের প্রায় ৩০ শতাংশ যাত্রী হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মালামাল ও স্বর্ণ নিয়ে আসে। একই ফ্লাইটে একই এলাকার লিমন নামের এক যুবকও স্বর্ণ নিয়ে এসে সকাল বেলায় পৌঁছে দেয়। ওইদিনই স্বর্ণ, ল্যাপটপ ও আইফোন বিক্রি করে হুন্ডি ব্যবসায়ী। এতে তার লাভ হয় ৪২ হাজার টাকা। মূলত; সকলের জন্য বিনা শুল্কে উন্মুক্ত থাকায় তৈরিকৃত কানের দুল, চেইন ও বালা মিলিয়ে ১০০ গ্রাম স্বর্ণ যে কেউ বহন করতে পারে।

জানা গেছে, বিমানের ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী বিদেশ থেকে আসা একজন যাত্রী স্বর্ণের বার আনার ক্ষেত্রে শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়েছে এবারের বাজাটে। নতুন নিয়মে বিদেশ থেকে একজন যাত্রী শুল্ক পরিশোধ করে ১১৭ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণের বার আনতে পারবেন। ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা অনুযায়ী আগে একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ২৩৪ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার আনতে পারতেন। বাজাটে প্রস্তাবনায় ১ জুন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশ থেকে আসা একজন যাত্রীকে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম বা ১ ভরি স্বর্ণ আনার জন্য শুল্ক ছিল ২ হাজার টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে একই পরিমাণ স্বর্ণ আমদানিতে শুল্ক ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। শুল্ক বাড়ানোর কারণে স্বর্ণের বার নিয়ে আসা অনেকটাই কমেছে। কিন্তু বেড়েছে তৈরিকৃত ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ নিয়ে আসার প্রবণতা। অনেকের সামর্থ না থাকলেও হুন্ডি ব্যবসায়ী চক্রের স্বর্ণ নিজের বলে বহন করে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় অথবা ব্যাগেজসহ বহন করলে আসার টিকেট ফ্রি পাচ্ছে। এভাবে স্বর্ণ দেশে আসা বন্ধে বিমানবন্দরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কাস্টমস্ কর্মকর্তারা কোন ব্যবস্থাও নিতে পারছে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি মাসে বিভিন্ন বিমানবন্দরে ৫০ থেকে ৬০ কেজি স্বর্ণ আটক করা সম্ভব হলেও বিশাল অংশ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের অধিকাংশই স্বর্ণ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে এই সিন্ডিকেট কয়েকটি ভাগে কাজ করে। দেশে আসার সময় প্রবাসী শ্রমিকরা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসেবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে স্বর্ণ বহন করে। অথবা সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার তুলনামূলক বেশি দামে কিনে নিয়ে ওই দেশেই স্বর্ণের দেনা পরিশোধ করে এবং বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ নিয়ে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করছে। বর্তমানে স্বর্ণ চোরাচালানচক্রের প্রধান টার্গেট দুবাই থেকে আসা যাত্রীরা। এ কাজে উৎসাহিত করতে নানা প্রলোভন দেওয়া হয়। কখনো বিমান টিকিট, কখনো কমিশন, আবার কখনো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের চেয়ে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়। বিদেশে প্রবাসী কর্মীরা রেমিটেন্স পাঠানোর সময় এই চক্রের লোকজন তাদের মাধ্যমে দেশে স্বর্ণ পাঠায়। এই স্বর্ণ বিক্রির পর প্রবাসী কর্মীদের টাকা পরিশোধ করা হয়। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি কুমিল্লা জেলা সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, ‘বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম স্বর্ণ যে কেউ নিয়ে আসতে পারায়, প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণ দেশে আসছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে স্বর্ণ নিয়ে আসা বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে’।

আরও পড়ুন...