বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি-বিরোধী মন্ত্রী। কিন্তু তার বিরুদ্ধেই যেন আর্থিক দুনীর্তির অভিযোগ জমে পাহাড় পরিমাণ হচ্ছে।
প্রথমে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকার আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নাম জড়ায় যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের রাজনীতি অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। সেই বিতর্ক থামার আগেই নতুন বিতর্কে জড়ান টিউলিপ। তার বিরুদ্ধে লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট উপহার পাওয়া নিয়ে মিথ্যচার করার অভিযোগ উঠেছে।
যুক্তরাজ্যের মেইল অন সানডে পত্রিকাকে টিউলিপ প্রথমে বলেছিলেন, উত্তর লন্ডনে অবস্থিত দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা কিনেছিলেন। তিনি এমপি হওয়ার আগে সেখানে বসবাস করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে লেবার পার্টির একাধিক সূত্র লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকার ফ্ল্যাটটি টিউলিপের বাবা-মাকে তাদের এক ‘পরিচিতজন’ উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত করেছে। ফ্ল্যাটটি উপহার হিসেবে যিনি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যোগ রয়েছে বলে খবর রটেছে।
একের পর এক অভিযোগ উঠায় দুর্নীতি-বিরোধী মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের বিরোধীদলীয় এমপিরা।
গত শনিবার (৪ জানুয়ারি) বিরোধী দলীয় এমপিরা দাবি জানিয়ে বলেছেন, “টিউলিপ সিদ্দিক যদি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে না পারেন, তাহলে তার মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।”
লন্ডনের হ্যারো ইস্টের টরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেছেন, “টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তির বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট এবং ব্যাখ্যা করতে হবে, আসলে তিনি কী বলেছিলেন এবং কেন। যদি তিনি তা না করেন, তাহলে মন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থান অগ্রহণযোগ্য হবে।”
ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ছায়ামন্ত্রী ম্যাট ভিকার্স বলেছেন, “সরকারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু সেই সদস্য যখন স্টারমারের দুর্নীতি-বিরোধী মন্ত্রী তখন তা আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ।”
তবে টিউলিপের পদত্যাগের দাবি ক্রমান্বয়ে জোরালো হওয়ার মধ্যেই গত রোববার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এখনো দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের প্রতি আস্থা রাখছেন।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) যুক্তরাজ্যের ডানপন্থি রাজনৈতিক ওয়েবসাইট গুইডো ফকস জানিয়েছে, টিউলিপ ও তার পরিবারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সম্পর্ক বেশ ভালো। তারা প্রতিবেশী সংসদ সদস্য। টিউলিপ স্টারমারকে লেবার পার্টির নেতৃত্বে সমর্থন দিয়েছিলেন। উভয় পরিবারের মধ্যে ভালো যোগাযোগ রয়েছে।
আর এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী স্টারমার তার দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী টিউলিপের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দলীয় প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গুইডো ফকস।
গুইডো ফকসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টারমার ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের বিরোধী দলীয় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তার ওই সফর ‘লেবার ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ নামে টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি সংস্থা অর্থায়ন করেছিল। যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্যদের তথ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে ‘স্টারমারস রেজিস্টার অব ইন্টারেস্ট’-এ লেখা রয়েছে, “২০১৬ সালে ৭ দিনের সফরটি ছিল আমার নির্বাচনী এলাকার রাজনৈতিক নেতা এবং বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য।”
সফরকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন স্টারমার।
বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর স্টারমার লন্ডনে শেখ হাসিনার সঙ্গে আবার দেখা করতে যান। ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে তিনি তার আবাসস্থলে শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। বৈঠকে স্টারমার তার দলীয় এমপি টিউলিপের খালা তৎকালীন স্বৈরশাসকের কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকারের সমস্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। যদিও, বিধি অনুযায়ী মানবাধিকার ইস্যুটি উত্থাপন করার কথা ছিল।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে লন্ডন সফরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সে সময় বিরোধী দলের নেতা ও লেবার পার্টির প্রধান স্টারমার এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘প্রয়াত রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লন্ডন সফররত অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবার দেখা করতে পেরে আনন্দিত হয়েছি। আমরা বাণিজ্য থেকে জলবায়ু পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতাসহ অনেক বিষয়ে আলোচনা করেছি। লেবার পার্টির সরকারের অধীনে আমরা বাংলাদেশের মতো আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে থাকব।”
গুইডো ফকসের প্রতিবেদনের সর্বশেষে বলা হয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিক ও তার স্বৈরশাসক খালার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের ব্যক্তিগত এই নৈকট্য যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির জন্য এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে।