মাহবুবুজ্জামান সেতু, মান্দা (নওগাঁ): নওগাঁর মান্দায় সনাতন ধর্মাবলম্বী তিন পরিবারকে ৩ মাস ধরে একঘরে করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমাজপতিদের চাপে মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে ও পুঁজা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলেও ভূক্তভোগী পরিবারগুলোর নিস্কৃতি মেলেনি।
স্থানীয় মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সমাজপতিদের এ সিদ্ধান্তে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন হতদরিদ্র পরিবারগুলো। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা ভাতহন্ডা গ্রামে।
অভিযোগ উঠেছে, একঘরে করে রাখা পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলায় ইতোমধ্যে গ্রামের ৯ জনকে গুনতে হয়েছে জরিমানা। গত ৩ মাস ধরে নেওয়া হয়নি পানি সাপ্লাইয়ের বিলসহ স্থানীয় সমিতির সঞ্চয়ের টাকা। যেতে পারছে না কাজেও। গ্রামের মোড়ের দোকান থেকে কিনতে পারছেন না প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। চড়তে দেওয়া হচ্ছে না গ্রামের অটোরিকশা কিংবা চার্জারভ্যানে।
ভূক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, সমাজপতিদের দাবিকৃত ১ লাখ টাকা না দেওয়ায় সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দুই সম্প্রদায়ের লোকজনদের চাপে তাঁরা দিশোহারা হয়ে পড়েছেন। থানা পুলিশকে জানিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না।
ভুক্তভোগী রামকৃষ্ণ প্রামানিক জানান, ছোটভাই গনেশ চন্দ্র প্রামানিকের ছেলে বিপ্লব প্রামানিক ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করাকালে মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়ে তানজিলা খাতুনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে তাঁকে বিয়ে করে বাড়ি আনেন।
তিনি আরো বলেন, ভাতিজা বিপ্লবও ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়ায় সমাজপতিদের চাপের মুখে পড়েন তাঁরা। পরে গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাতবরদের ডেকে তাঁদের হাতে ভাতিজা বিপ্লব (ধর্মান্তরিত নাম আব্দুর রহমান) ও ভাজিতা বউ তানজিলাকে তুলে দেওয়া হয়। পরে গ্রামের লোকজন গ্রামের পূর্বধারে ভাই গনেশের জমিতে বাড়ি করে দেন। এ ঘটনায় নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের চাপে প্রায়শ্চিত্ত করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী গনেশের স্ত্রী মাধবী রানী বলেন, ‘গত ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সিংগা-বালুকা মাদরাসায় আয়োজিত ইসলামী জালসায় যাবার কথা বলে ছেলে বিপ্লব নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে সে নিরুদ্দেশ রয়েছে। ছেলে নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে আমাদের হাত রয়েছে বলে দোষারোপ করেন উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন। এক পর্যায়ে ছেলেকে বের করে দেওয়ার জন্য চরম চাপ সৃষ্টি করা হয়। পরে গ্রামের মর্ডাণ ক্লাব চত্বরে আয়োজিত সালিসে আমাদের তিন পরিবারকে একঘরে করেন সমাজপতিরা।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গ্রামের আব্দুল জব্বারের ৪ বিঘা ২ কাঠা জমি একবছরের জন্য ৪০ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছিল। ধান কাটার সময় বাধা দিয়ে ২ বিঘা ১ কাঠা জমির ধান কেটে নিয়ে মাড়াইয়ের পর চেয়ারম্যান (দুর্নীতির দায়ে বরখাস্তকৃত) ব্রজেন সাহা খড় ও ক্লাবে ধান জমা রাখেন সমাজপতিরা। পরে সেগুলো আর ফেরত দেওয়া হয়নি।
এদিকে একঘরে পরিবারগুলোর লোকজনের সঙ্গে কথা বলায় জরিমানা গুনতে হয়েছে ওই গ্রামের সাইফুল ইসলাম, খোরশেদ আলম, শেফালি বেগম, মনসুর রহমান, ময়মুল ইসলামসহ ৯ জনকে।
এদের মধ্যে খোরশেদ আলম বলেন, ‘একঘরে করে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণ প্রামানিকের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের ছেলে উৎপল প্রামানিক এবারের ঈদে বাড়ি আসেন। গত শনিবার (৩১ জুলাই) উৎপলের স্ত্রী শিলা রানী ঢাকায় যাবার আগে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলায় আমার ও আমার স্ত্রী শেফালি বিবির ৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে মাতবররা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, ৩ মাস ধরে ওই পরিবারগুলোর ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে এটা অমানবিক। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
তিন পরিবারকে একঘরে করে রাখার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন গ্রামের মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি ও সমাজপতি আব্দুল জব্বার। তিনি বলেন, দুই সম্প্রদায়ের লোকজনের উপস্থিতিতে ওই পরিবারগুলোকে আটক দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। একঘরে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে জরিমানার টাকা যেভাবে আদায় করা হচ্ছে সেভাবেই খরচ করা হচ্ছে।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যান ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, একঘরে করে রাখার বিষয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘন। দেখি এ বিষয়ে কি করা যায়।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এটা অমানবিক। ঘটনাকে কেন্দ্র জরিমানা আদায় কোন নিয়মের মধ্যেই পড়ে না।
মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিনুর রহমান এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিষয়টি দেখা হচ্ছে।
মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু বাক্কার সিদ্দিক বলেন, ঘটনার তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।