ইউনুস আলী ফাইম নওগাঁ: কোভিট-১৯ করোনা ভাইরাসকালীন দিনরাত সরকারের দেওয়া দায়িত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় থেকে কাজ করে গেছে ক্লান্তিহীন নওগাঁ পুলিশ সুপার (এসপি) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বিপিএম। পুলিশ সুপারের এই কার্যক্রম জেলার কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা যেমন প্রচার করেছে তেমনি জেলা পুলিশ সুপারের সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরায় প্রতিদিন নওগাঁবাসি স্বাগত জানিয়েছেন। নওগাঁবাসি মনে করছেন, কোভিট-১৯ করোনা ভাইরাসকালীন সরকারের দেওয়া দায়িত্ব, সামাজিক দায়বদ্ধতায় নিজের নিরাপত্তা বজার রেখে এসপি যে ভাবে ক্লান্তিহীন কাজ করেছেন তা প্রসংশনীয়। তার ব্যক্তিত্ব ও কাজের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছে অনন্যতায়।কৃষি প্রধান জেলা নওগাঁয় ধান ও চাল উৎপাদনে সারাদেশের মধ্যে অন্যমত জেলা হিসেবে পরিচিত। চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে প্রায় ১লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের বাম্পার ফলনও হয়। কৃষকরা যখন কাটা মাড়াই শুরু করবে সে সময় করোনা সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। শ্রমিক সংকট নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ্য ও দিশেহারা হয়ে পরেন। সে সময় কৃষকরা যাতে সুন্দর ভাবে দ্রুত ধান ঘরে তুলতে পারেন সে জন্যে সরকারি ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নির্দেশণা প্রদান করেন। এরপর জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি নওগাঁ পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়ার বিভিন্ন জেলায় ধান কাটা শ্রমিকদের যোগাযোগ করা হয়। এরপর এসপির সহযোগিতায় ১১ থানায় পুলিশের মাধ্যমে দিনাজপুর, পাবনা, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্দাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে নওগাঁয় আসা ধান কাটার শ্রমিকদের মাস্ক, সাবানসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করেন। ফলে কৃষি বিভাগে লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিকটন চাল থাকলেও লক্ষমাত্রার বেশি ১৮ লাখ মেট্রিকটন চাল অর্থাৎ সাড়ে লাখ মেট্রিকটন চাল সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
চলতি আম মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে নওগাঁ আম উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে পরিচিত হলেও সেখানে মাত্র আড়াই লাখ মেট্রিকটন উৎপাদন হয়েছে। নওগাঁয় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়েছে।
নওগাঁয় চলতি মৌসুমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হওয়ার আশা করেন আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা। করোনা পরিস্থিতির কারণে সারাদেশে থেকে আম ব্যবসায়ীরা নওগাঁয় আসতে না পারায় পোরশা-সাপাহার-নিয়ামতপুরের আম চাষিরা নিরাশ হয়ে পারেন। এমতাবস্তায় পোরশা-সাপাহার-নিয়ামতপুরের আসনের সাংসদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার একাধিকবার আম চাষিদের আম সারাদেশে বিক্রির করতে প্রশাসনকে বিভিন্ন দিক নির্দেশণা দেন। পুলিশের উদ্যোগে নওগাঁকে “আমের রাজধানী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জন্যে সাপাহারে আম ব্যবসায়ী, চাষী ও আড়ৎদারদের সাথে মত বিনিময় সভায় অনুষ্ঠিত হয়।
সভা শেষে পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া ব্যবসায়ী ও চাষিদের সুবিধার্থে সাপাহারে আম বাজারে একটি পুলিশ কন্ট্রোলরুম স্থাপন করে নিরাপত্তা প্রদানসহ রাস্তার নিরাপত্তা, আম বহনকারী ট্রাক রাত্রিবেলায় নওগাঁ সীমান্তে নিরাপদে গমনের ব্যবস্থা করে দেওয়া, রাস্তায় ডাকাতি ছিনতাই রোধকল্পে সাপাহার থানায় অতিরিক্ত দুটি গাড়ি প্রদান করেন। এ ছাড়া আম বাজার থেকে বা ট্রাক থেকে কোন প্রকার চাঁদাবাজি হবে না মর্মে হুশিয়ারি ও আশ্বাস প্রদান করেন।
নওগাঁ জেলা পুলিশের অফিসার ফোর্সগণ প্রতিদিন নিয়ম করে পিটি ও ব্যায়ামে অংশগ্রহণ করেন। পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি থানা ও পুলিশ ইউনিট সমূহে পর্যাপ্ত মাক্স, হ্যান্ড সেনিটাইজার, পিপিই, ফেইস শিল্ড, গ্লোবস, ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডার ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়েছে।
পুলিশী করোনা যুদ্ধের অন্যতম সম্মুখযোদ্ধা নওগাঁ জেলা পুলিশের যেসব সদস্যের, শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের নিয়ে বিশেষ সাস্থ্য সচেতনতামূলক মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। ডিউটিকালীন সময়ে নওগাঁ জেলা পুলিশের সদস্যরা যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করে এবং নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন সে লক্ষ্যেই এই মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে।
নিহত স্বজন বঞ্চিত মৃতদেহগুলো পাচ্ছেনা শেষ সমাদর। অজানা মৃতদেহ সৎকার পুলিশের দাফনকাজ সম্পন্নকরার জন্য কোন বাঁধাই পিছু হটাতে পারেনি অদম্য পুলিশ সদস্যদের। বদলগাছী থানার মেয়ে নাসিমা বেগম। পোশাক কারখানার শ্রমিকের কাজ করেন জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে নাসিমা বেগমের মৃত্যু হয়। নিহতের মরদেহ গ্রামে নিয়ে আসা হলে গ্রামবাসী বাঁধা দেন। লাশ দাফন নিয়ে শুরু হয় নানা বিপত্তি। নিহতের মামার জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানান। কোন সম্পর্কই যখন এগিয়ে এলো না তখন বদলগাছী থানার এসআই আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে ইসলামিক ফাউ-েশনের প্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে পুলিশ সদস্যরাই কবর খুঁড়ে লাশটি নদীর ধারে কবর দেয়।
করোনা মহামারীর এই ক্রান্তিকালে পাহাড়পুর থেকে জামালগঞ্জ যাওয়ার রাস্তার মাঝ খান রাত ৮টার দিকে হঠাৎ করেই পথচলতি মানুষের কানে আসে পাকুড় গাছের দিক হতে মানব শিশুর কান্নার শব্দ। এরপর স্থানীয়রা ব্যাগের ভেতরে রাখা একটি জলজ্যান্ত ৩/৪ বয়সের ফুটফুটে নিষ্পাপ মেয়ে কে বা কাহারা শিশুকে ফেলে রেখে যান। স্থানীয়দের ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে যায় পাহাড়পুর ফাঁড়ি ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম। তৎক্ষণাৎ শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা প্রদান করেন। করোনাভাইরাসের এই ক্রান্তিলগ্নে নওগাঁ পুলিশের ৪২ জন সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসা ও সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। যাদের মধ্যে ৩৭ জন সদস্য সুস্থ হয়েছেন এবং তাদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগদান করছেন। নওগাঁ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ হাততালি দিয়ে করোনা বিজয়ী যোদ্ধাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে সরকারি নির্দেশনা পুলিশ সুপার স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি তদারকি ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেন। বাংলাদেশের মধ্যে ধান-চাউল ও সবজি উৎপাদনের জন্য নওগাঁ জেলার অবস্থান শীর্ষে। ধান-চাউল ও সবজি সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে ক্রয় করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের জন্য একমাত্র পরিবহণ ট্রাক। এ ক্ষেত্রে ট্রাক মালামাল নামিয়ে দিয়ে (খালাস) করে খালি ট্রাক চলাচলের পথে কোন বাঁধাপ্রাপ্ত যেন না হয়। সেই লক্ষ্যে জেলা পুলিশ সংশ্লিষ্ট জেলার সাথে আলোচনা করে সমাধান করেছে।
নওগাঁর এক নিভৃতচারী পরোপকারী পুলিশ কনস্টেবল সারোয়ার। নাম পরিচয়হীন, কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান নিজ উদ্যোগে। সুস্থ হবার পরে তাকে তার নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার জন্য তার নাম, ঠিকানা জানার চেষ্টা করলেও বৃদ্ধা সঠিকভাবে তা বলতে পারেন না। থাকার ব্যবস্থা হলেও খাবারের জন্য কি করা যায় ভাবতে থাকেন। পরে সারোয়ারের সহধর্মিনী নিজে দুইবেলা রান্না করে বৃদ্ধার জন্য খাবার পাঠাতে শুরু করেন। এভাবেই গত চার মাস থেকে সকলের অগোচরে বৃদ্ধা মায়ের সেবা-শুশ্রুষাসহ সকল দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ কনস্টেবল সারোয়ার।করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশ পুলিশ সামনে থেকে লড়াই করে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, চেকপোস্ট ও টহল ডিউটির পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য অসহায় ও দরিদ্র জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের বেতন ভাতার টাকা থেকে এমনকি রেশনের চাল, ডাল, তেল দিয়ে সাহায্য করে চলেছে নিম্নায়ের মানুষদের। জেলায় প্রায় ১৫শ’ হত দরিদ্র পরিবারের মাঝে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পুলিশ সুপার, সিনিয়র অফিসার অথবা অফিসার ইনচার্জদের কাছে সহায়তা চাইলে গোপনে তাদের বাড়িতে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন এবং তা চলমান আছে।
নওগাঁ পুলিশ সুপার উদ্যোগে জেলার প্রায় ৯শ’ জন গ্রাম পুলিশদের মাঝে ঈদের সুভেচ্ছা সামগ্রী তুলে দেয়া হয়। করোনযুদ্ধে সহযোদ্ধা সংবাদকর্মীদের জন্য পুলিশের শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে ৭৬ জন সংবাদকর্মীকে শুভেচ্ছা উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়। নিয়ামতপুর থানার দরিদ্র আধিবাসি জনগোষ্ঠীর অসুবিধার কথা বিবেচনা করে ১০০টি পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন পুলিশ সুপার মহোদয়।
নওগাঁ জেলা পুলিশের আহবানে নওগাঁ জেলার ৫৮জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী গত ৮মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিকট আত্মসমর্পণ করে অন্ধকার থেকে আলোর পথের অভিযাত্রী হয়েছিলেন। পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়ার নির্দেশনায় তাদেরকে সর্বদা মনিটরিং এ রাখা হতো এবং তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া হতো। তারই ধারাবাহিকতায় ২৪ এপ্রিল পুলিশ সুপার নিজে সদর থানাধীন আত্মসমর্পণকারীদের বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন রকমের খাদ্যদ্রব্য সামগ্রী উপহার হিসেবে দিয়ে আসেন। নওগাঁ পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বিপিএম জানান, আইজিপির দিক নির্দেশনায় নওগাঁ জেলায় ৯৯টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভায় বিট পুলিশের কার্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আইজিপি মহোদয় আশাবাদ ব্যক্ত করেন এখন থেকে মানুষ থানায় পুলিশী সেবা নিতে আসবে না, পুলিশই মানুষের দোরগোড়ায় সেবা প্রদান করবে। আগামী এক মাসের মধ্যেই জেলায় বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে ১১৫ টি’রও অধিক বিট পুলিশের কার্যালয় স্থাপন করে জনগণের মাঝে পুলিশি সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আগামিতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতায় তিনি কাজ করে যান। এ জন্যে সকলের সহযোগিতা ও দোয়া চেয়েছেন।
পিবিএ/এসডি