নদেরচাঁদ হৃদয়বিদারক এক নির্মম ট্রাজেডি

সুমন খান, পিবিএ,বোয়ালমারী,ফরিদপুর: ইংরেজদের ভারতবর্ষে আগমনের প্রাক্কালে-ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলাধীন মধুমতি নদীর তীরে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক নির্মম ট্রাজেডি। লোকসাহিত্য ও ইতিহাসে যা নদেরচাঁদ এর আখ্যান হিসেবে পরিচিত। নির্মম এই ট্রাজেডি নিয়ে রয়েছে নানা লোককথা, রয়েছে সমৃদ্ধশীল ইতিহাস। জারি, সারি, গল্প-উপাখ্যানে ঘুরে ফিরে আঞ্চলিকতা, ভাষার গন্ডি পেরিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় স্থান পেয়েছে নদেরচাঁদের আখ্যানটি। বেশ কিছু দিন যাবৎ এই ইতিহাস নিয়ে শুরু হয়েছে টানা হেঁচড়া, আঞ্চলিকতার দাবিতে বিকৃত করা হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস।

ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত ও লোকসাহিত্যের শোকগাঁথা বুকে ধারণ করে আজও বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের কামারহিলা মৌজা, নদেরচাঁদের স্মৃতি বুকে ধারণ করে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি গ্রাম। এই গ্রামেই উপজাতি বা আদিবাসীদের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন নদেরচাঁদ। ঐতিহাসিকগণ প্রায় সকলেই একমত যে, স্বাধীন নৃপতি রাজা সীতারাম রায় ভূষণা রাজ্যের অধিপতি হিসেবে রাজ্য শাসনকালীন ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে কৃষি কাজে পারদর্শী, পাহাড়ী জনগোষ্ঠির লোকদের নিয়ে আসেন নিজ শাসনাধীন অঞ্চলে। এই পাহাড়ীরাই বর্তমানে আদিবাসি বা বুনো হিসেবে ফরিদপুর অঞ্চলে পরিচিত।

প্রথমে রাজা সীতারাম রায়ের জন্মভূমি হরিহরনগরের নিকট মধুমতি নদীর তীরে ঢোলভাঙ্গা মৌজায় আদিবাসিদের বসতি স্থাপনে দান করেন শত শত বিঘা জমি। খর¯্রােতা মধুমতি নদীর ভাঙ্গনে এক সময় বিলীন হয়ে যায় ঢোলভাঙ্গা গ্রাম। আদিবাসিগণ নতুন করে বসতি স্থাপন করে বর্তমান নদেরচাঁদ ঘাট সংলগ্ন কামারহেলা মৌজায়। এখানেই জন্ম হয় ইতিহাসের নায়ক নদেরচাঁদের। প্রকৃত তার নাম ছিল চাঁদ। আদিবাসিরা কৃষি কাজ করলেও সীতারামের পতনের পর নতুন শাসকরা কেড়ে নেয় তাদের জমিজমা। বেঁচে থাকার তাগিদে নানা পেশায় যুক্ত হয় তারা। চাঁদের পিতা নেয় পাটনির কাজ, মধুমতির এপার থেকে ওপার লোকজনকে পার করাই ছিল তার পেশা। বিবাহের অনেক বছর কেটে গেলেও নিঃসন্তান ছিল চাঁদের পিতা-মাতা। মধুমতির ঘাটে একদিন চাঁদের পিতার সাথে পরিচয় হয় এক তান্ত্রিকের। মন্ত্রসিদ্ধ তান্ত্রিকের দেওয়া তদবিরে জন্ম হয় ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের। পিতা-মাতা নাম রাখে চাঁদ। পাটনি দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল চাঁদ। পিতার মৃত্যু পরবর্তীতে চাঁদ পিতার পেশাকেই জীবন-জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। ছোট বেলা থেকেই মায়ের কাছে শুনেছে তন্ত্রবলে তার জন্ম হয়েছে, তাই শৈশব থেকেই মন্ত্রতন্ত্র শেখার প্রতি ঝোঁক ছিল তার। ইচ্ছাপূরণে মা ও স্ত্রীকে রেখে তন্ত্র-মন্ত্র শিখতে পাড়ি জমান ভারতের আসাম রাজ্যের কামরুপ-কামাখ্যায়।

প্রায় ১যুগ সেখানে কঠোর সাধনার পর মন্ত্রসিদ্ধ হয়ে নিজ জন্ম ভূমিতে ফিরে আসে চাঁদ। মানুষের বিভিন্ন উপকারী ঝাড়ফুঁক ছাড়াও মন্ত্র বলে বিভিন্ন পশুর রূপ ধারণ করতে পারতেন তিনি । কিন্তু কখনই মানুষের উপকারী তদবির ছাড়া অন্যান্য ম্যাজিক জাতীয় কিছুই দেখাতেন না তিনি। এ নিয়ে পাড়া প্রতিবেশিরা নানা ঠাট্টা, মস্করা করত। কোন কিছুতেই গা করতেন না তিনি। কিন্তু বউয়ের অনুরোধে কোন এক প্রভাতে মন্ত্রপড়ে কুমির হন চাঁদ। কুমির হওয়ার আগে দুই কলস পানি পড়ে স্ত্রীকে বলে যান আমি কুমির হওয়ার পর পাড়া প্রতিবেশিকে দেখিয়ে পড়া পানি গায়ে ছিটিয়ে দিলেই মানুষ রূপ ধারণ করবো আমি । কিন্তু দুর্ভাগ্য চাঁদের! আকস্মিক মানুষ থেকে কুমিরে হওয়া চাঁদকে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তার স্ত্রী এলোকেশি। এলোকেশীর আত্মচিৎকারে ছুটে আসে পাড়া প্রতিবেশি। উঠানের মাঝে মস্ত এক কুমির দেখে প্রতিবেশিরা ধারণা করে পারশ্ববর্তী মধুমতি নদী থেকে উঠে এসেছে কুমিরটি। কুমিরটিকে তাড়াতে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে গ্রামের যুবকরা।

এসময় কুমিরটি লেজ দ্বারা একটি কলসকে কুন্ডলী পাকিয়ে বাঁচাতে চেষ্টা করে। যুবকদের সরকি, বল্লমের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ছুটোছুটির সময় ভেঙ্গে যায় মন্ত্র পড়া কলস, দড়দড় করে পানি গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। মন্ত্রপড়া পানির ছিটেফোঁটা কুমিরের শরীরের যেখানে লাগে সেখানে বেরিয়ে আসে মানুষের রূপ। স্থম্ভিত হয়ে যায় গ্রামবাসি। তত সময় চেতনা ফিরে পায় এলোকেশি। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনায় সবাইকে। পড়া পানির কলস ভেঙ্গে যাওয়ায় আর মানুষ হওয়া হয় নাই চাঁদের। শোকে-দুঃখে এক হৃদয় বিদারক সকাল নেমে আসে কামারহেলা অঞ্চলে । গ্রামবাসি ও চাঁদের মা চেষ্টা চালায় চাঁদকে আবার মানুষ রূপে ফিরিয়ে আনার। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক হওয়ায়, চাঁদের উস্তাদকে আনতে দেরি হয়ে যায় অনেক। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সাত দিন পর মধুমতিতে খাদ্য সংগ্রহ ও আবাস হিসেবে বেছে নেন তিনি। কথিত আছে জলে নেমে জলজপ্রাণী আহার করায় আর মানুষ হওয়া হয়নি চাঁদের। অবাক হলেও সত্য প্রতিদিন চাঁদের দুঃখিনী মা খাবার নিয়ে ঘাটে বসে চাঁদ বলে ডাক দিলে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ডাঙ্গায় এসে খাবার খেয়ে যেত চাঁদ। তখন খর¯্রােতা মধুমতি নদীতে বড় বড় স্টিমার চলত। স্টিমার চড়ে বাণিজিক কাজে এ অঞ্চলে আসতো ইংরেজ বণিকরা। তেমনি একটি স্টিমার থেকে মধুমতি নদীর জলে ভেসে থাকা চাঁদ কে গুলি করে হত্যা করে ইংরেজ বণিক। গুলি খেয়ে মধুমতির অতলে নিমজ্জিত হয় চাঁদের মৃতদেহ। আবারও শোকের অন্ধকার নেমে আসে মধুমতি পারের কামারহেলা ও হরিহরনগর গ্রামে।

ইতিহাসের এই সত্য ঘটনা অবলম্বনে দুই বাংলায় নির্মিত হয়েছে নাটক, যাত্রাপালা ও সিনেমা। আজও স্থানটি চাঁদের স্মরনে মধুমতি নদের নামের সাথে মিলিয়ে স্থানটি নদেরচাঁদ ঘাট হিসেবে পরিচিত।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে লোকসাহিত্যের শোকগাঁথাটি কোনোরূপ গবেষণা না করেই নানাজন, নানাভাবে উপস্থাপন করে যাচ্ছে । আঞ্চলিকতার দাবিতে কৌশলে বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস। নতুন প্রজন্ম পরিচিত হচ্ছে ভুল ইতিহাসের সাথে।

স্থানটি ৩টি জেলার সংযোগ স্থলে অবস্থিত বিধায় অন্যান্য জেলার লোকও দাবী করে তাদের ঐতিহ্য বলে। প্রকৃত স্থানটি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলায় । এব্যাপারে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলাধীন গুনবহা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি সত্য ও ইতিহাস দ্বারা প্রমানিত। গবেষণায় প্রমানিত ইতিহাসকে পার্শ্ববর্তী জেলার ঐতিহাসিকদের দাবী ইতিহাসকে বিকৃত করার সামিল। সরকারের প্রতি এলাকাবাসির পক্ষ থেকে জোর দাবী, সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার নদের চাঁদ ঘাটে Ñনদেরচাঁদের নামে একটি স্মারক স্থাপনের ।

পিবিএ/হক

আরও পড়ুন...