মানবতার মহান মুক্তির দূত; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদকে (সা:) আল্লাহ ছোবহানাহু তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন- তেমাদের জন্য রাসুলের জীবনীর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তার প্রতিটি কথা, কাজ, অনুমোদন, নির্দেশনা, আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ গোটা মানব জাতির দুনিয়া– আখেরাতের কল্যাণের বার্তাবাহী। তার সে কালজয়ী আদর্শ ও অমিয়বাণী দ্যুাতি ছড়িয়ে পথপ্রদর্শন করেছে যুগযুগান্তরে আলোকিত হয়েছে মানবমণ্ডলী।
মুহাম্মাদ (সা.)। সর্বকালের সব যুগের সেরা আদর্শ। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন- ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭)
– ‘তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে; যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ২১)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব কথা ও কাজ ছিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। দুনিয়ার জীবনের উন্নত দিকনির্দেশনা। তাঁর অসংখ্য আদর্শের মধ্যে জীবনঘনিষ্ঠ কিছু আদর্শ তথা উপদেশ তুলে ধরা হলো-
* সালাম দেয়া
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম গুণ ছিল- তিনি সবাইকে আগে আগে সালাম দিতেন। সাধারণ কেউ তাকে আগে সালাম দিতে পারতেন না। এটি ছিল বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম শিক্ষা। এ কারণেই তিনি বলেছেন- ‘কথা বলার আগে সালাম দাও।’
* আল্লাহকে বেশি স্মরণ করা-
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নই ছিল বিশ্বনবীর মিশন। তিনি সব সময় সব কাজে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতেন এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে বলতেন। আল্লাহর নির্দেশ-
– ‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো আর আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫২)
– হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ কর।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৪১)
– হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ কর; যাতে তোমরা উদ্দেশ্য কৃতকার্য হতে পার।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ৪৫)
*তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়-
যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে চায়, তাদের উচিত যত্নের সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাজ নিয়মিত পড়া। কোরআনের বিভিন্ন সুরায় এ নামাজের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িসহ সব যুগের ওলি ও বিদ্বানরা তাহাজ্জুদ নামাজে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামকে বিশেষভাবে (রাতে) তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে চাদর আবৃত, রাতের সালাতে দাঁড়াও; কিছু অংশ ছাড়া।’ (সুরা মুজাম্মিল : আয়াত ১-২)
*নামাজ পড়া
নামাজ ছিল প্রিয় নবীর জীবনের শ্রেষ্ঠ ইবাদাত ও আদর্শ। এমনকি তিনি যখন কোনো বিপদে পড়তেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আবার কোনো কারণে কষ্ট বা হতাশা বা চিন্তাগ্রস্ত হলেও তিনি তাৎক্ষণিক নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।
* নীরবতা পালন
– তিনি দীর্ঘ সময় নীরব থাকতেন। আল্লাহর কাছ থেকে ওহি ছাড়া কোনো কথা তিনি বলতেন না। এ কারণেই নীরব থাকা বিশ্বনবীর অন্যতম সুন্নাত ও ইবাদত।
* কম হাসা
– তিনি কম হাসতেন। কেননা বেশি হাসলে মুমিনের অন্তর নিস্তেজ হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন বেশি বেশি কাঁদো; অল্প অল্প হাসো। এটি কোরআনুল কারিমেরও নির্দেশনা-
‘অতএব, তারা সামান্য হেসে নিক এবং তারা তাদের কৃতকর্মের বদলাতে অনেক বেশি কাঁদবে।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৮২)
*মুচকি হাসি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুচকি হাসি হাসতেন। এ হাসি অনেক উপকার বয়ে আনে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সৎ আমলের কোনো কিছুকেই তুচ্ছ মনে করো না, যদি তা (সৎ আমলটি) তোমার নিজের ভাইয়ের সঙ্গে মুচকি হাসি দিয়ে মিলিত হওয়ার দ্বারাও হয়। (মুসলিম) মুসলমানের জন্য এটাও একটা সদকা।
* প্রতিশোধ পরায়ন না হওয়া
কারো প্রতি প্রতিশোধ না নেয়া ছিল বিশ্বনবীর অন্যতম আদর্শ। হদযোগ্য কোনো অপরাধ না থাকলে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া। কেউ অপরাধ করে থাকলে ধৈর্যধারণ করাও শ্রেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জন্য কখনোই প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না।
*আঘাত না করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কাউকে আঘাত করতেন না। শারীরিক আঘাত তো দূরের কথা তিনি কথা বা আচরণ দিয়েও কাউকে কষ্ট দিতেন না। তবে যুদ্ধের ময়দানে কিংবা হদযোগ্য অপরাধের কথা ভিন্ন।
* শিশুদের স্নেহ করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমলমতি শিশুদের বেশি স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ব্যক্তি একটি শিশু নিয়ে বিশ্বনবীর খিদমতে এসে শিশুটিকে চুমু দিতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দৃশ্য দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, শিশুটির প্রতি কি তোমার দয়া জেগে উঠেছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ’, হে আল্লাহর রাসুল! তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়া করেন। কেননা তিনি দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (বুখারি)
* পরিবারের সঙ্গে কোমল আচরণ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোমল আচরণ করতেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোমল ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। খাবার-দাওয়া, কেনা-কাটা, সাংসারিক কাজে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ও উত্তম জিনিস দেয়াকে উত্তম ইবাদত ও খরচ বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং হাদিসের দিকনির্দেশনা হলো-
– প্রথমেই পরিবার পরিজনের চাহিদা মেটানো। যাতে তারা সব সময় অভাবমুক্ত থাকে। যা পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব।
– মৃত্যুর সময় ওয়ারিশদেরকে স্বচ্চল অবস্থায় রেখে যাওয়া। যাতে করে অভিভাবকের মৃত্যুর পর কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয়।
*রোজা পালন
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি সপ্তাহে দুই দিন (সোম ও বৃহস্পতিবার) রোজা রাখতেন। মাসে ৩ দিন (আইয়্যামে বিজ) চন্দ্র মাসের ১৩-১৫ তারিখ রোজা রাখতেন।
*মেসওয়াক করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুম থেকে ওঠে মেসওয়াক করতেন। প্রত্যেক ওজুতে মেসওয়াক করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম বিশ্বনবীকে এতবেশি মেসওয়াক করার তাগিদ দিয়েছেন যে, তিনি মেসওয়াক ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার আশংকা করতেন।
* মিথ্যা পরিহার করা
মিথ্যা সব পাপের জননী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় মিথ্যা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। তিনি মিথ্যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন।
* উপহার গ্রহণ করা
উপহার দেয়া এবং নেয়া সুন্নাত। কেউ কাউকে উপহার দিলে তা গ্রহণ করার উৎসাহ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া বা উপহার গ্রহণ করতেন এবং নিজে ব্যবহার করতেন। কেননা তিনি সাদকা খেতেন না।
* সাদকা বা দান করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি সাদকা করতেন। ইসলামের জন্য সাদকা করতে হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার সমূদয় সম্পদ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিয়েছিলেন। আর তিনি তা দ্বীনের পথে ব্যয় করেছেন। বেশি বেশি সাদকা বা দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যখন কোনো সাদকা আসতো তিনি তা সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
* খাবারের দোষ না ধরা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো খাবারের দোষ ধরতেন না। কোনো খাবার খেতে ভালো না লাগলে তিনি তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। হাদিসের এসেছে-
হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনোই কোনো খাবারের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতেন না। খাবার পছন্দ ও রুচি হলে তিনি তা খেতেন। আর পছন্দ ও রুচি না হলে তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন।’
* ক্ষমা করা
ক্ষমা মহান আল্লাহ তাআলার অন্যতম গুণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ক্ষমা করতে ভালোবাসতেন। তিনি অন্যদের ক্ষমা করে দেয়াকে বেশি পছন্দ করতেন। হাদিসে পাকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষমার ব্যাপারে এভাবে দোয়া করতেন এবং তাঁর উম্মতেকে দোয়া করতে বলতেন-
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওয়ুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)
*কাউকে অবহেলা না করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কাউকে অবহেলা করতেন না। কারো মর্যাদা বিনষ্ট হোক এটা তিনি কামনা করতেন না। সবার প্রতি তিনি উদার ছিলেন। বিশেষ করে তার কাছে আসা সব ব্যক্তিকেই তিনি সমাদর করতেন। গুরুত্ব দিতেন। তাদের কথা শুনতেন। সুতরাং কাউকেই অবহেলা করা ঠিক নয়।
* সুস্পষ্ট কথা বলা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সুস্পষ্টভাষী। তিনি ছিলেন সত্যমিথ্যার পার্থক্যকারী। সত্যের মানদণ্ডে তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী। কথা বলার সময় তিনি সুস্পষ্টভাষায় কথা বলতেন। তার কথা ছিল প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। এমন কেউ ছিলেন না যিনি প্রিয় নবীর কথা বুঝতেন না। সুতরাং কথা বলার ক্ষেত্রে সবার উচিত, সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবীর এ গুণগুলো যথাযথভাবে মেনে চলার তাওফিক দান করুন। বিশ্বনবীর আদর্শে নিজেকে রাঙিয়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।