নামাজের দুনিয়াবী উপকার

নবীজি (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ যখন সালাত আদায় করে, তখন সে তার পালনকর্তার সঙ্গে গোপনে কথা বলে (বুখারি)। হাশরের ময়দানে আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেবেন। ঈমানের পরেই সালাত বা নামাজের গুরুত্ব। আল্লাহ তায়ালা সাত আসমানের উপর নামাজ ফরজ করেছেন। নবীজিকে (সা.) মেরাজের রাতে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি সালাতের দায়িত্ব অর্পণ করে সব উম্মতের ওপর ফরজ করেন।
মুসলমানরা পরকালের উপকারের কথা ভেবে তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে বেহেশতে যাওয়ার জন্যই নামাজ পড়ে। কিন্তু এই নামাজ আদায় থেকে আমরা ইহকালীন অনেক উপকারও পেয়ে থাকি। যেমন— পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, সামাজিকতা, ব্যায়াম ইত্যাদি। নিম্নে সেসব উপকার আলোকপাত করা হলো।

পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা : নামাজ পড়ার আগে আমাদের অজু করতে হয়। অজু ছাড়া নামাজ হয় না। অজু হচ্ছে নামাজের প্রস্তুতি। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা যখন নামাজের জন্য প্রস্তুত হবে তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নেবে এবং তোমাদের মাথা হাত দিয়ে মুছে নেবে (মাসেহ করবে) এবং দুই পা গোড়ালি পর্যন্ত ধুয়ে নেবে।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৬)

শুধু যে নামাজের জন্য অজু তথা হাত-পা ইত্যাদি ধুতে হয় তা নয়, গড়গড়া করে কুলিও করতে হয় এবং নাকের ভেতরে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। তা ছাড়া শরীর, নামাজের স্থান ও পোশাক পাক-পবিত্র হতে হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানদের সারা দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়।

আল্লাহর সাহায্য লাভ : নামাজ পড়ার মাধ্যমে দুনিয়াবি বহু সমস্যা সমাধান হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে (আল্লাহর কাছে) সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৩)

সময়ানুবর্তিতা : কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘নির্ধারিত সময়ে নামাজ পড়া মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০৩)। একজন মুমিন ব্যক্তিকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঁচটি নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হয়। ফলে সে সময়ের প্রতি সচেতন হয় এবং সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। এভাবে সে সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পায়, যা তাকে জীবনের সব কাজে সময়নিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল করে তোলে।

মনের প্রশান্তি : কোরআনে এসেছে, ‘যারা ঈমান আনে আল্লাহর ওপর এবং তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে (জিকিরে) প্রশান্ত হয়; জেনে রেখো, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮) আর নামাজের দ্বারা মুমিন ব্যক্তির মন সর্বাধিক প্রশান্ত হয় এবং সে মানসিকভাবে শান্তিতে থাকে।

অশ্লীললতা থেকে মুক্তি: আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে’ (সুরা আনকাবুত, ৪৫)। নামাজ পড়লে দুনিয়ার সব খারাপ, অন্যায় কাজ থেকে আল্লাহ তায়ালা তাকে কুদরতি হাতে হেফাজত করবেন। যে ব্যভিচার, জুলুম করবে না, সুদ-ঘুষ থেকে নিজেকে গোটাবে; নেশা, খুন, রক্তপাত থেকে দূরে থাকবে, তার সব অন্যায় বর্জনের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন হবে কল্যাণময়।

সামাজিকতা : নামাজের সময় মুসলমানরা নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায়। ফলে পরস্পর দেখাশোনা, খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ হয়। তাই তাদের মধ্যে একতা, মমতা, সহমর্মিতা বাড়ে। জামাতে দাঁড়ানোর সময় গরিব-ধনীর, আমির-ফকিরের কোনো ভেদাভেদ থাকে না।

বিপদে অবিচল থাকা : নামাজ আদায়কারী বিপদ-আপদে অবিচল থাকে। সে কোনো কাজে বা বিষয়ে বিরূপ অবস্থায় পতিত হলে হতাশায় ভেঙে পড়ে না। কোরআনে এসেছে, ‘মানুষ তো স্বভাবতই বড়ই অস্থিরচিত্ত। সে বিপদে পড়লে হা-হুতাশ করতে থাকে। আর যখন কল্যাণপ্রাপ্ত হয় তখন কৃপণ হয়ে পড়ে। তবে তারা নয়, যারা নামাজ আদায়কারী, যারা তাদের নামাজে নিরন্তর নিষ্ঠাবান।’ (সুরা : মাআরিজ, আয়াত : ১৯-২৩) অর্থাৎ যথাযথভাবে নামাজ আদায়কারী বিপদে অবিচল থাকতে পারে।

ব্যায়াম : নামাজের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক উভয় ব্যায়ামই সাধিত হয়। নামাজের দ্বারা শরীরের সব অঙ্গের নড়াচড়ার ফলে এগুলো সচল থাকে এবং স্বাস্থ্য রক্ষিত হয়। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় বিধায় নামাজিদের হৃদয় প্রশান্ত থাকে। তাই নামাজিদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং তারা মানসিক অসুখসমূহ যেমন—হতাশা, বিষণ্নতা, অস্থিরতা, অহেতুক ভয় ইত্যাদি থেকে নিরাপদ থাকে।

নামাজ শরীরের জোড়াগুলোকে (ঔড়রহঃ) শক্ত হয়ে অচল হয়ে যাওয়া রোগ (চধৎধষুংরং) থেকে রক্ষা করে। নামাজের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে রুকুতে ও সিজদাতে যাওয়া-আসার এবং রুকু ও সিজদায় কিছুক্ষণ অবস্থানের কারণে কোমর ও পিঠের সংশ্লিষ্ট হাড়ের জোড়াগুলো শক্ত হতে পারে না। ফলে সেগুলোরও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় থাকে। এখন নামাজের বিভিন্ন অবস্থায় যেসব ব্যায়াম সাধিত হয় এবং এর দ্বারা যেসব উপকার পাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হলো—

(১) তাকবিরে তাহরিমা : ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজে যখন হাত দুটো কান পর্যন্ত ওঠানো হয় এবং এরপর হাত বাঁধার জন্য নামানো হয় তখন বাহুদ্বয়ের ব্যায়াম হয়ে যায়। এ ছাড়া কনুইয়ের সামনে যে অঙ্গগুলো এবং কাঁধের জোড়ার যে অঙ্গগুলো এ নিয়ত বাঁধার সময় ব্যবহৃত হয় সেগুলোরও এর সঙ্গে ব্যায়াম হয়ে যায়।

(২) দাঁড়ানো (কিয়াম) : নামাজে দাঁড়ানোর সময় মেরুদণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দাঁড়াতে হয়। এটা মেরুদণ্ডকে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।

(৩) হাত বাঁধা : নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় হাত বাঁধার সময় কনুইয়ের আগে-পিছে থাকা পেশি এবং বগলের পেছনের পেশির ব্যায়াম হয়ে যায়। নামাজে বাঁ হাত নিচে পেটের ওপর রাখা হয় এবং এর ওপর ডান হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখা হয়। এর ফলে হাতের তালু, আঙুল ও কবজির ব্যায়াম হয়।

(৪) রুকু : দুই হাঁটুর ওপর হাত রেখে কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত সামনে ঝোঁকানো অবস্থাকে রুকু বলা হয়। এখানে মাথাকে এমনভাবে ঝোঁকাতে হয়, যাতে কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত শরীর মেঝের সমান্তরাল থাকে। এ নড়াচড়ায় শরীরের সংশ্লিষ্ট পেশিগুলোর ব্যায়াম হয়ে যায়। রুকু দ্বারা মূত্রাশয়ের উপকার হয় এবং চোখের প্রান্তে ও মস্তিষ্কে রক্ত পরিসঞ্চালন বৃদ্ধির ফলে চোখের ও মস্তিষ্কের উপকার হয়।

(৫) সিজদা : সিজদার সময় মাথা হার্ট থেকে নিচু অবস্থায় থাকে। এতে মাথায় রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। সিজদা যত দীর্ঘ সময় হয় তত বেশি রক্ত মস্তিষ্কে ও মুখমণ্ডলে প্রবাহিত হয়। এর ফলে নামাজি ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং মুখের চেহারার ওপর সতেজতা থাকে। সিজদার ফলে হাত, পা, কোমর ও পিঠের ব্যায়াম হয়। সিজদার দ্বারা পেট, পেটের নিচের অংশের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া হয় ও রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম ইত্যাদি রোগেরও উপকার হয়।

(৬) বৈঠক : নামাজের বৈঠক অবস্থায় হাঁটু ও নিতম্বের ওপর চাপ পড়ে; বিশেষ করে চাপ পড়ে পায়ের গোড়ালির ওপর। এভাবে এ অঙ্গগুলোর ব্যায়াম হয়ে যায়।

(৭) সালাম ফেরানো : নামাজ শেষে বসা অবস্থায় ডান ও বাঁ দিকে সালাম ফেরানো হয়। এতে শরীরের শুধু মাথা ও ঘাড় ডান দিকে ও বাঁ দিকে ফেরানো হয়। এটা ঘাড়ের উত্তম ব্যায়াম, যা নামাজের মাধ্যমে সাধিত হয়।

আসল কথা হলো, নামাজের দ্বারা আত্মিক উন্নতি হয়। নামাজের মাধ্যমে একজন মুসলমান নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের ফলে আত্মিক দিক দিয়ে সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ধ্যানে তার মন প্রশান্ত হয়। এভাবে পরকালের পাশাপাশি ইহকালেও নামাজ বহুমুখী কল্যাণ বয়ে আনে।

আরও পড়ুন...