পিবিএ,খুলনা ব্যুরো: দীর্ঘ ২২ বছর বন্ধ থাকা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল্স লিমিটেডের পরিত্যাক্ত জমিতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)র উদ্যোগে সরকারিভাবে ঔষধ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল তৈরির একটি কারখানা নির্মাণ হতে যাচ্ছে।
বিসিআইসি’র (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান রসায়নবিদ মৌসুমী দত্ত জানান, বিসিআইসি খুলনা নিউজপ্রিন্ট ও খুলনা হার্ডবোড মিলের জমিতে ঔষধ তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনের একটি কারখানা নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। এ্যাকটিভ ফার্মাসিটিউক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে এটি বর্তমানে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজল (ডিপিপি) পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে পরবর্তীতে একনেকে চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
মৌসুমী দত্ত আরো জানান, দেশে ক্রমবর্ধমান ঔষধের চাহিদার কারণে এ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৯০% বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। বাকী ১০% কাঁচামাল বেসরকারিভাবে চট্টগ্রাম ও ঢাকার মাত্র কয়েকটি কারখানায় তৈরি হয়। এছাড়া সরকারি হাসপাতালের জন্য এশেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানী লিঃ (ইডিসিএল) ঔষধ তৈরি করে থাকে, তারাও আমদানী নির্ভর কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, দেশে কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবু সাঈদ বলেন, মিলের ৮৮ একর জমির মধ্যে ৫০ একর জমি ইতিমধ্যে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানী লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে এই কোম্পানী ‘রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ স্থাপন করেছে। বাকী জমিতে সরকারিভাবে ঔষধ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল তৈরির কারখানা নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিসিআইসি। মোঃ আবু সাঈদ বলেন, কারখানাটি নির্মাণ হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রায় এক হাজার পাঁচশত মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।
এর আগে সেখানে ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সার কারখানা নির্মাণের ঊদ্যোগ নেয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয় বলে জানিয়েছেন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবু সাঈদ। তিনি জানান, দেশে টিএসপি সারের বাজার দর যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে মরক্কো ও রাশিয়া থেকে টিএসপি সার তৈরির কাঁচামাল আমদানী করে দেশে তৈরি সারে উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। এছাড়া মাদার ভ্যাসেলে করে টিএসপি’র কাঁচামাল আমদানী করতে কমপক্ষে ৯ মিটার নদীর গভীরতা লাগবে অথচ খালিশপুরে ভৈরব নদের বর্তমানে নাব্যতা ৩/৪ মিটারও হবেনা। লাইটার ভ্যাসেলে কাঁচামাল খালাশ করতে গেলে খরচ আরো বাড়বে, বিধায় বিসিআইসি ও শিল্প মন্ত্রনালয় এ প্রকল্প থেকে পিছিয়ে এসেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার নিউজপ্রিন্ট মিল্সের পরিত্যাক্ত জমি পরিদর্শনকালে সেখানে একটি টিএসপি সার কারখানা নির্মাণ উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেন। পরিদর্শনকালে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)র চেয়ারম্যান মোঃ হাইয়ুল কাইয়ুম, পরিচালক (বাণিজ্যিক) মোঃ আামিনুল আহসানসহ বিসিআইসির উদ্ধর্তন কর্মকর্তারা প্রতিমন্ত্রীর সাথে ছিলেন।
উল্লেখ্য, শিল্প ও বন্দরনগরী খুলনার খালিশপুরে ভৈরব নদের তীরে গোয়ালপাড়া মৌজায় ৮৮দশমিক ৬৮ একর জমির ওপর ১৯৫৭ সালে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল্সের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। পাঠ্যপুস্তক, র্যাপার বোর্ড ও সংবাদপত্র মুদ্রণে কাগজের চাহিদা পূরণ করতে সুন্দরবনের গেওয়া কাঠের ওপর ভিত্তি করে ১৯৫৯ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। তখন মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৮ হাজার মেট্রিক টন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে লাভজনক থাকা মিলটি ১৯৯২ সাল থেকে লোকসান গুনতে থাকে।
১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে নিউজপ্রিন্টের ওপর ৭৫ শতাংশ আমদানী শুল্ক প্রত্যাহারের পর অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে কাগজ আমদানী শুরু করেন। ফলে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে উৎপাদিত ৫২ গ্রামের নিউজপ্রিন্টের চাহিদা অনেক কমে যায়। চাহিদা কম থাকলেও তা কোনরকমে সামলে উঠেছিল মিলটি। কিন্তু কাঁচামাল গেওয়া কাঠের উৎপাদক সুন্দরবনকে বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণার পর বিপাকে পড়ে মিল কর্তৃপক্ষ। কাঁচামালের সংকটে অব্যাহতভাবে লোকসান দিতে শুরু করে মিলটি। মাত্র সাত বছরে (১৯৯৫ থেকে ২০০২) মিলটির লোকসানের পরিমাণ দাড়ায় ২৮৪ কোটি টাকা। বিগত জোট সরকারের আমলে ক্রমাগত লোকসান এবং মূলধনের ঘাটতির কারণে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর সাইরেন বাজিয়ে মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েন।
মিলের চাকরিচ্যুত শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ফের মিলটি চালু ও রক্ষার চেষ্টা করা হয়। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে গত ২৭ আগস্ট খুলনা জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, মিলটি পূনরায় চালু করার জন্য খুলনাবাসী অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এখানে ভিন্ন কিছু করার প্রস্তাব দেওয়া হয় সরকারকে। তিনি আরও বলেন, নিউজপ্রিন্ট মিলের বাকী জমিতে নতুন কারখানা হবে বলে শুনেছি, কিন্তু কবে নাগাদ হবে তা জানা সম্ভব হয়নি।