প্রতি পরতে পরতে রোমাঞ্চ সাজিয়ে বসেছিল মুম্বাইয়ের ওয়ানখেড়ে। ভারত খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল মাত্র ২৯ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে। তবে ঋষভ পান্তের ব্যাটের তালে সেই পেন্ডুলাম দুলছিল দু’দিকে। মনে হচ্ছিল এই ভারত, না আবারও নিয়ন্ত্রণ সফরকারী নিউজিল্যান্ডের হাতে। তবে পান্তের লড়াই থামিয়ে কিউইরাই তুলে নিলো জয়। ২৪ বছর পর নিজেদের দুর্গে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হলো ভারত।
হ্যান্সি ক্রনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ২০০০ সালে সর্বশেষ ঘরের মাঠে টেস্টে ধবলধোলাই হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের ভারত। এরপর নিজের ঘরে হোয়াইটওয়াশ তো দূরের কথা, পরবর্তী দুই দশকেই কেবল একটি টেস্ট সিরিজ হারে। সেই হারের পর সময়ের হিসাবে এক যুগ এবং ১৮ সিরিজ অপরাজেয় ছিল রোহিত-কোহলিরা। সেই বৃত্ত তো ভেঙেছে–ই, ২৪ বছর হোয়াইটওয়াশ না হওয়ার কীর্তিও তছনছ করে দিয়েছে নিউজিল্যান্ড।
তবে ভারত প্রোটিয়াদের বিপক্ষে আগের হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে। এবার তাদের আরও বড় তিন ম্যাচের সিরিজে তিক্ত পরাজয়ের গ্লানিতে ডোবাল টম ল্যাথামের কিউই শিবির। মুম্বাইয়ের ওয়ানখেড়ে স্টেডিয়ামে কিউইদের দেওয়া ১৪৭ রানের লক্ষ্যটা ছোট মনে হলেও, আদতে রোহিতের শহরটি নাটকীয় রোমাঞ্চ মঞ্চস্থ করতে প্রস্তুত ছিল। নিজেদের বানানো স্পিন ফাঁদে আটকে ভারতীয় ইনিংস থেমেছে ১২১ রানে।
ভারতের মাটিতে টেস্টে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রান ডিফেন্ড করে জিতলো নিউজিল্যান্ড। ১৪৬ রানের পুঁজি গড়ে তাদের জয় এসেছে ২৫ রানে। রোহিতদের দুর্গে সবচেয়ে কম রানের লক্ষ্য দিয়ে জয়ের রেকর্ডটাও এসেছিল এই ওয়ানখেড়েতেই। যদিও সেবার ভারত জিতেছিল, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদের টার্গেট ছিল ১০৭ রানের। ভারত সেই ম্যাচটি ১৩ রানে জিতলেও ২-১ ব্যবধানে অজিরাই সিরিজ জিতে। এরপর নিজেদের দুর্গে ভারত সিরিজে অপরাজেয় ছিল ১২ বছর।
এর আগে ওয়ানখেড়ে স্টেডিয়ামে গতকাল দ্বিতীয় দিন শেষে নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ উইকেটে ১৭১ রান তুলেছিল। আজ (রোববার) তৃতীয় দিনে খেলতে নেমে তার খেলেছে কেবল ৮ বল। দিন শুরুর ১৪ মিনিটেই গুটিয়ে যায় সফরকারীদের ইনিংস। ১৭৪ রান তুললেও ভারতের (২৮) লিড পেরিয়ে তাদের পুঁজি দাঁড়িয়েছে ১৪৬ রানের। সেই রানও কঠিন করে তুলেছেন এজাজ প্যাটেলরা (৩ উইকেট)।
ভারতের সামনে লক্ষ্যটা ছোট হলেও বেশ কঠিনই হতে পারে বলে আগেই ধারণা করা হচ্ছিল। কারণ ওয়ানখেড়েতে টেস্টে এর আগে পাঁচবার রান তাড়া করতে নেমে ভারত জিততে পেরেছে মাত্র একবার। আর হেরেছে তিনবার। ড্র করেছে একটিতে। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টা এসেছিল আবার মাত্র ৪৮ রানের লক্ষ্য পেরিয়ে। অন্য চারটি ম্যাচেই অবশ্য লক্ষ্যটা ২৪০ রানের বেশি ছিল। সবমিলিয়ে ওয়ানখেড়ে স্টেডিয়ামেই রানতাড়া করে জয়ের নজির আছে মোটে ৫ বার। তার মাঝে কেবল একবারই ১০০ এর বেশি টার্গেটে ব্যাট করে কোনো দল জয় পেয়েছে।
ছোট তবে কঠিন এই সমীকরণ নিয়ে লক্ষ্য তাড়ায় ভারত তৃতীয় ওভারেই ওপেনার রোহিতের উইকেট হারায়। পুরো সিরিজজুড়ে ব্যর্থতার বৃত্তে আটকে থাকা রোহিত ও বিরাট কোহলি এদিনও ফিরেছেন দলের বিপদ বাড়িয়ে। চাপ কমাতে ম্যাট হেনরির বলে মিডউইকেটের ওপর উড়িয়ে মারেন ভারত অধিনায়ক, গ্লেন ফিলিপস পেছনে দৌড়ে সেই ক্যাচ তালুবন্দী করেন দারুণভাবে। ১১ বলে ১১ রানে ফেরেন রোহিত।
সেই ধাক্কা সামলানোর আগে পরের ওভারেই আউট প্রথম ইনিংসে দারুণ দৃঢ়তায় ৯০ রান করা শুভমান গিলও (১)। প্যাটেলের বলটি বেরিয়ে যাবে মনে করে ছেড়ে দিয়ে তিনি অফস্টাম্প হারিয়েছেন। এমন বিপদে কোহলিও (১) দলের হাল ধরতে ব্যর্থ। নিজের সপ্তম বলেই প্যাটেলের ডেলিভারি তার ব্যাট ছুঁয়ে স্লিপে থাকা ড্যারিল মিচেলের হাতে ধরা পড়ে। ব্যাট মাটিতে রেখে কিছুক্ষণ নিচু হয়ে যেন এই ব্যর্থতার জবাব পেতে চাইলেন এই ভারতীয় তারকা।
বিপদের ষোলোকলা পূর্ণ করে যশস্বী জয়সওয়াল ও সরফরাজ খান ফিরলেন মাত্র দুই বলের ব্যবধানে। জয়সওয়াল ব্যক্তিগত ৫ রানে এলবিডব্লু হয়েছেন ফিলিপসের বলে। অন্যদিকে, সরফরাজের (১) আউটের ধরন হয়তো তার দলে জায়গা হারাতে যথেষ্ট হয়ে উঠতে পারে। বিপদের মুহূর্তেও তিনি মাটিতে পা বিছিয়ে বাউন্ডারি খেলতে গিয়ে ক্যাচ দেন রাচিন রবীন্দ্রের হাতে। ২৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ভারত যেন আগেই হার নিশ্চিত করেছে। তবে আশা টিকেছিল ক্রিজে রিষাভ পান্ত থাকায়। তিনি তার কাজটা করলেনও ঠিকঠাক, তবে টপ-অর্ডারের ব্যর্থতা তো আর তাতে সামলানো সম্ভব নয়!
এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার প্রথমে রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে ৪২ এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে গড়েন ৩৫ রানের জুটি। যা ভারতের লজ্জা এড়ানোর সম্ভাবনা জাগালেও পান্তের বিদায়েই শেষ হয়ে যায় যাবতীয় আশা। ম্যাচের নায়ক এজাজ প্যাটেলের বলে আউট হওয়ার আগে পান্ত করেন ৬০ রান। তার ৫৬ বলের ইনিংসে ৯টি চার ও এক ছক্কার বাউন্ডারি রয়েছে। এরপর কেবল কিউইদের ইতিহাস গড়ার মুহূর্তটি আসতে বিলম্ব হচ্ছিল। ১২১ রানে ভারতীয়রা অলআউট হতেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে যায়।
কিউইদের হয়ে সর্বোচ্চ ৬ উইকেট শিকার করেছেন মুম্বাইয়েই জন্ম নেওয়া বাঁ-হাতি স্পিনার প্যাটেল। প্রথম ইনিংসেও ৫ উইকেট নেওয়া এই তারকা ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন। গ্লেন ফিলিপস নিয়েছেন ৩ উইকেট। সিরিজজুড়ে ব্যাট হাতে দারুণ ধারাবাহিক উইল ইয়াং (২৪৪) হয়েছেন সিরিজসেরা। অথচ তিনি একাদশে ঢুকেছিলেন অভিজ্ঞ ব্যাটার কেইন উইলিয়ামসনের ইনজুরিতে।