রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক্ব এবং সুরা নাস ৩বার পড়বে; এগুলোই তার সবকিছুর (নিরাপত্তার) জন্য যথেষ্ট হবে।’ হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এ সুরার অনেক বৈশিষ্ট্য ও প্রাপ্তির কথা ওঠে এসেছে। যা মানুষের যাবতীয় কল্যাণের জন্য যথেষ্ট। এ তিন সুরার পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতাগুলো তুলে ধরা হলো-
সুরা ইখলাস –
সুরা ইখলাস, আল্লাহর একত্ববাদের অনন্য বৈশিষ্ট ও পরিচয় সমৃদ্ধ সুরা। কুরআনুল কারিমের ১১২তম ও ছোট্ট সুরা এটি। কুরআনুল কারিমের সুরাগুলোর মধ্যে এ সুরার তেলাওয়াত ও আমলের প্রবণতাই মানুষের মধ্যে বেশি। কুরআনুল কারিমের ৪ আয়াত বিশিষ্ট ছোট্ট সুরাটি হিজরতের আগে মক্কায় অবতীর্ণ হয়। সুরার নামের অর্থ থেকেই এর ফজিলত, মর্যাদা ও নেয়ামত প্রকাশ পায়।
অর্থসহ সুরাটির উচ্চারণ তুলে ধরা হলো-
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ – اللَّهُ الصَّمَدُ – لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ – وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
উচ্চারণ : কুল হুয়াল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্চামাদ। লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ। ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।’ (মাখরাজসহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখে নেয়া জরুরি )
অর্থ : (হে রাসুল! আপনি) বলুন, তিনিই আল্লাহ, একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। আর তার সমতুল্য কেউ নেই।’ (সুরা ইখলাস)
সুরা ফালাক্ব –
সুরা ফালাক্ব কুরআনুল কারিমের ১১৩ তম সুরা। এটি ৫ আয়াত, ১ রুকু সমৃদ্ধ সুরা। শয়তানের আক্রমণ ও জাদুটোনাসহ সব ধরনের অনষ্টিতা থেকে মুক্ত থাকতে এ সুরার নিয়মিত আমলই মানুষের জন্য যথেষ্ট।
সুরাটিতে মহান আল্লাহ তাআলা তার কাছে আশ্রয় চাওয়ার কৌশল তুলে ধরেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এ সুরাটি অনন্য নেয়ামত। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় সুরাটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে।
অর্থসহ সুরাটির উচ্চারণ তুলে ধরা হলো-
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ – مِن شَرِّ مَا خَلَقَ – وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ – وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ – وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
উচ্চারণ : কুল আউজু বিরাব্বিল ফালাক্ব; মিন শাররি মা খালাক্ব; ওয়া মিন শাররি গাসিক্বিন ইজা ওয়াক্বাব; ওয়া মিন শাররিন নাফ্ফাছাতি ফিল উক্বাদ; ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইজা হাসাদ। (মাখরাজসহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখে নেয়া জরুরি )
অর্থ : বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে। অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়, গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।
সুরা নাস-
সুরাটি ৬ আয়াত, ১ রুকু সমৃদ্ধ কুরআনুল কারিমের সর্বশেষ (১১৪তম) সুরা। এর প্রতিটি আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের অনষ্টিতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। সুরার প্রথম তিন আয়াতে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করা হয়েছে। আর পরের তিন আয়াতে জ্বিন ও মানুষরূপী শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় গ্রহণের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
অর্থসহ সুরাটির উচ্চারণ তুলে ধরা হলো-
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ – مَلِكِ النَّاسِ – إِلَهِ النَّاسِ – مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ – الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ – مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ
উচ্চারণ : কুল আউজু বিরাব্বিন নাস; মালিকিন্ নাস; ইলাহিন্ নাস। মিন্ শররিল ওয়াস্ওয়াসিল খান্নাস; আল্লাজি ইউওয়াসয়িসু ফি ছুদুরিন নাস। মিনাল ঝিন্নাতি ওয়ান নাস। (মাখরাজসহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখে নেয়া জরুরি )
অর্থ : বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানুষের পালনকর্তার কাছে, মানুষের অধিপতির কাছে, মানুষের মাবুদের কাছে। তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্মগোপন করে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।
সুরা ৩টির বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা
- হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রাতে যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন নিজের উভয় হাত এক সঙ্গে মিলাতেন। তারপর সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস পড়তেন এবং উভয় হাতে ফুঁক দিতেন। তারপর দেহের যতটুকু অংশ সম্ভব হাত বুলিয়ে নিতেন। তিনি মাথা, মুখমণ্ডল ও শরীরের সামনের অংশ থেকে শুরু করতেন। তিনি এরূপ তিনবার করতেন।’ (বুখারি)
- হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে, শয়তানের অনিষ্ট ও জাদুটোনা থেকে বাঁচতে সকাল-সন্ধ্যায় এ ৩ সুরার আমল খুবই কার্যকরী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা সুরা ইখলাস ও এই দুই সুরা ( সুরা ফালাক ও সুরা নাস) পড়বে সে সব বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (তিরমিজি)
- ফজর আর মাগরিবের এই দুই ওয়াক্তের ফরজ নামাজের পর সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস প্রতিটি তিনবার করে পড়া সুন্নত। অন্যান্য ফরজ সালাতের আদায় করে একবার করে এই তিন সুরা পড়ার কথা বলা হয়েছে।’ (আবু দাউদ)
- হজরত উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমার কি জানা নেই আজ রাতে আমার ওপর যে আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে এগুলোর মতো কোনো আয়াত দেখাও যায়নি এবং শোনাও যায়নি। আর তাহলো- কুল আউজু বি রাব্বিল ফালাক ও কুল আউজু বি রাব্বিন নাস।’ (মুসলিম)
- একবার এক ইয়াহুদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ওপর জাদু করেছিল। যার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে জিবরিল আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন যে, এক ইয়াহুদি তাকে জাদু করেছে এবং যে জিনিস দিয়ে জাদু করা হয়েছে তা একটি কুপের মধ্যে পাথরের নিচে আছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই জিনিস কূপ থেকে উদ্ধার করার জন্য লোক পাঠালেন। সেখানে গিয়ে কয়েকটি গিরা পাওয়া গিয়েছিল। তখন তিনি সুরা নাস ও ফালাক্ব একসঙ্গে পড়ে ফুক দেন আর গিরাগুলো সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে বিছানা থেকে ওঠেন।’
- হজরত ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে এমন তিনটি সুরার কথা বলছি, যা তাওরাত, ইঞ্জিল, জবুর এবং কুরআনে অবতীর্ণ হযেছে। রাতে তোমরা ততক্ষণ ঘুমাতে যেয়ো না, যতক্ষণ সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস না পাঠ কর। ওকবা বলেন, সেদিন থেকে আমি কখনও এ আমল পরিত্যাগ করিনি।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মসিবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট হয়।’ (ইবনে কাসির)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কুরআনুল কারিমের সর্বশেষ তিনটি ছোট্ট সুরার নিয়মিত আমল করা। সকাল-সন্ধ্যায় (ফজর ও মাগরিবের পর) ৩ বার এবং অন্য তিন ওয়াক্তে ১বার করে নিয়মিত তেলাওয়াত করা। আর এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দান করবেন-
- জান্নাত।
- আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি।
- গোনাহ থেকে মুক্তি।
- দারিদ্র থেকে মুক্তি।
- বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি।
- জাদুটোনা থেকে মুক্তি।
- শয়তানের আক্রমণ থেকে মুক্তি।
- যাবতীয় অনিষ্টতা থেকে মুক্তি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস-এর তেলাওয়াত করার তাওফিক দান করুন। হাদিসে ঘোষিত ফজিলত ও উপকারিতা পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।