নিরাপত্তা চাইতে গিয়ে কারাগারে কুবি শিক্ষার্থী

জাহিদুল ইসলাম,কুবি: হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ময়নুল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়, সোমবার (২০ মে) পুলিশ সুকৌশলে তাকে থানায় নিয়ে এসে আটক করে। তবে একাধিকসূত্রের দাবি, ময়নুল নিজের নিরাপত্তা চেয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালী মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে তাকে আটক করা হয়। এদিকে যে কমেন্ট নিয়ে আলোচনা ও মামলা সেই কমেন্ট নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে ধ্রুম্রজাল।

 

জানা যায়, গত ১৯ মে রাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে ‘Shamol Chandra Das’ নামের একটি ফেসবুক একাউন্টের একটি পোষ্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। যাতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ময়নুল ইসলাম আবির নামের একাউন্ট থেকে একটি পেইজে হিন্দু ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়।
তবে ময়নুল নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, এই মন্তব্যটি তিনি করেননি। কেউ তার নাম এবং ছবি ব্যবহার করে ভুয়া একাউন্ট খুলে এমন একটি মন্তব্য করে তাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। পরবর্তীতে স্ক্রিনশট ভাইরাল করা ‘Shamol Chandra Das’ নামক একাউন্ট ঘুরে দেখা যায়, একাউন্টটির ইউজার নেইম ‘moynulislam.abir.35’ এবং একাউন্টের অন্যান্য তথ্যও সঠিক নয়।

ময়নুলের দাবি, তাকে ফাঁসিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরীর জন্যই একটি মহল ইচ্ছাকৃতভাবে তার নামে একাউন্ট খুলে তা দিয়ে সাম্প্রদয়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।
এদিকে ওই রাতেই ২৫ থেকে ৩০ জন অজ্ঞাতনামা লোক ময়নুলের খোঁজে তার বাসায় যায়। এ ঘটনার পর সোমবার (২০ মে) ময়নুল কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানায় নিরাপত্তা চেয়ে একটি সাধারণ ডায়রি করতে যায় বলে জানা যায়। সেখানে তিনি জিডি লিখে জমা দেওয়ার শেষ মুহূর্তে তার জিডি না নিয়ে তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে এমনকি তার সাথে কাউকে দেখা করতে ও কথা বলতে দেয়নি পুলিশ।

জিডি করতে যাওয়ার সময় তার সাথে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম হানিফ বলেন, ‘২০ মে দুপুরে ময়নুল জিডি করতে যায়। পরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ময়নুলকে রেখে দেন। এরপর রাতে খোঁজ নিলে জিজ্ঞাসাবাদে আরও সময় লাগবে বলে জানায়। পরে জানতে পারি তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ ময়নুলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮(১) এবং ৩১(১) ধারায় কুমিল্লার কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন উপ-পুলিশ পরিদর্শক খালেকুজ্জামান।

মামলাটি তদন্ত করছে কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার এজহারে বর্ণিত আছে,‘গত ১৯ মে রাত অনুমান ১০.৫২ ঘটিকায় ময়নুল ’Ashiqur Rahman Rabbani’ এর ফেসবুক একটি স্টাটাসের কমেন্ট বক্সে “বাংলাদেশের মালাউনগুলোকে জোতাপেটা করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হোক। সেখানে গিয়ে সেক্সি মা দূর্গার সাথে সেক্স না করলে এগুলোর বৃদ্ধি হবে না। এদেশের মাটিতে মালাউনদের ঠাই নাই।” লিখে কমেন্ট করে। কিন্তু যে শ্যামল চন্দ্র দাশ নামের আইডি থেকে কমেন্টটি ছড়ানো হয়েছিল সেই আইডির ভাষ্য ও স্টাটাস অনুযায়ী জানা যায়, ময়নুল তার ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে ‘পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম সম্প্রদায়’ নামক একটি ফেসবুক পেইজে ‘মোদী সরকারের আমলে মুসলমানরা কেন ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত’ শিরোনামের একটি পোস্টে উক্ত কমেন্টটি করে। কিন্তু ঐ পেইজ ঘুরে স্টাটাস, অন্যান্য কমেন্টের সত্যতা পাওয়া গেলেও ময়নুলের কমেন্টের অস্তিত্ত পাওয়া যায়নি। শ্যামল চন্দ্র দাশ নামের আইডির অন্য এক স্টাটাসের ভাষ্য অনুযায়ী ময়নুল নামের একাউন্ট থেকে করা কমেন্টটি মুছে দেয়া হয়।

কিন্তু ‘Ashiqur Rahman Rabbani ’ ফেসবুক আইডিটির ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান রাব্বানী বলেন,‘মামলার এজহারে যে স্টাটাসের কথা বলেছে সেটি আমি ময়নুলের কমেন্ট ভাইরাল হওয়ার পরে দিয়েছি। সেক্ষেত্রে সেই কমেন্ট কিভাবে আমার স্টাটাসের হয়? এমনকি ময়নুলকে আমি চিনিও না এমনকি সে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে নেই। সে আমার কোন স্টাটাসে কমেন্ট করেনি।’
এদিকে শ্যামল চন্দ্র দাশ নামের আইডিটিও একটি ফেক আইডি বলে দাবি করছে শিক্ষার্থীরা। মামলার তদন্তের নথিসূত্রে আরও বলা হয়, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মইনুল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। আসামী সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্যেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হিন্দু সম্প্রদায় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবী দুর্গাকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। মামলাটির তদন্ত অব্যহত রয়েছে।’
ময়নুলের মেস সদস্য শুভ’র দাবি, ‘ঘটনার দিন (২০ মে) ময়নুল মেসে ছিলো না। আর মেস থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।’
মামলার বিষয়ে কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইনুদ্দীন জানান, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় মো. ময়নুল হোসেনকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
এদিকে ময়নুল ইসলাম আবিরকে ‘নিরপরাধ’ দাবি করে তার নিঃশর্ত মুক্তি ও শ্যামল চন্দ্র দাশ নামের ফেইসবুক আইডির আসল পরিচয় উদঘাটনের দাবিতে বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁঠাল তলায় মানববন্ধন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ। শিক্ষার্থীদের দাবি ‘বিশ্বিবদ্যালয়ের সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চেষ্টা চলছে। শ্যামল চন্দ্র দাশের আইডি ফেইক হওয়ার পরেও কেন আবিরকে আটক করা হবে? শ্যামলের পরিচয় আগে কুবিয়ানদের সামনে প্রকাশ করা হোক। শ্যামল নামের সেই ফেইক আইডির কে বা কারা চালাচ্ছে সেটি বের করা আমাদের প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব। অথচ তা না করে আবিরকে মামলা দেওয়া হয়েছে।’
মামলার এজহারে কমেন্টের বিষয়ে কেন Ashiqur Rahman Rabbani ব্যবহার করা হয়েছে এবং একটি উড়ো কমেন্টের স্টাটাসের উপর ভিত্তি করে ময়নুলকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ময়নুলের মামলার দায়িত্বে থাকা কুমিল্লার ডিবি পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর মোঃ ইকতেয়ার উদ্দিন বলেন,‘আমরা মামলাটি সিআইডিতে তদন্তের জন্য এক্সপার্ট অপিনিয়নে পাঠিয়েছি। সেখানে মামলাটি চলমান আছে। ময়নুল কমেন্টটি কোথায় করেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না কমেন্ট করেছে কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাদের কাছে বলেছে সে কমেন্টটি করে নাই। হয়তো কেও তার আইডি হ্যাক করে কমেন্টটি করেছে। এ সবকিছুই তদন্তের পরে বেড়িয়ে আসবে।’

পিবিএ/জেআই/হক

আরও পড়ুন...