
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, ‘আজকে দেশের বিভিন্ন দিকে তাকালেই অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, আমরা লক্ষ করে দেখেছি, এই সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে আমরা বলে আসছি, বিএনপি চায় এই সরকারকে সফল করতে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গত কিছুদিন ধরে আমরা দেখছি, সরকারের ভেতরে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন রকম কথা বলছেন। যার ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।’
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেল পাঁচটার দিকে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সম্মেলনে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তারেক রহমান। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার টাউন হল মাঠে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপি বাংলাদেশে অস্থিরতা দেখতে চায় না জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা দেশে অস্থিরতা চাই না। বিগত স্বৈরাচারী সরকার দেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমরা চাই এখন দেশ গঠন করতে। আমরা চাই দেশে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে। কারণ, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই দেশে স্থিতিশীলতা আনা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কিছু লোকের বক্তব্যে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা এই সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। কারণ, এই সরকার যত সুন্দরভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারবে, আগামী দিনের গণতান্ত্রিক যাত্রা ততই সুদৃঢ় হবে। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষ যে নিরপেক্ষতা আশা-প্রত্যাশা, তাঁরা সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু মতপার্থক্যের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও গণতান্ত্রিক দলগুলো। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা যত বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকব, তত বেশি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পনাকারীদের ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাবে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচন বিলম্বিত হলে কারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবে, এটাও দেখার বিষয়। বিএনপি বিশ্বাস করে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা যত অব্যাহত রাখা যায়, তত বেশি বাংলাদেশের মানুষ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে নিরাপদে থাকবে। দেশে যদি ভোটের অধিকার নিশ্চিত থাকে, তাহলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে।’
বিএনপি জনগণের শাসনে বিশ্বাস করে বলেই নির্বাচনে চায় উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণের কাছে ভোট চাওয়া ও নির্বাচন করা। আজকে কিছু কিছু লোক কথায় কথায় বলে ওঠে বিএনপি শুধু নির্বাচন চায়, নির্বাচন ছাড়া কিছু বোঝে না। বিএনপি জনগণের শাসনে বিশ্বাস করে, জনগণের রাজনৈতিক শক্তিতে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তাই আমরা নির্বাচন চাইব, জনগণের কাছে ভোট চাইব—এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এই স্বাভাবিক ব্যাপারকে কিছুসংখ্যক লোক কেন অস্বাভাবিক করতে চাইছেন, সেটি আমাদের চিন্তা করে দেখতে হবে। এখানে অন্য কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটি আমাদের ভেবে দেখতে হবে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের শুধু মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করলেই হবে না, যে ভোটের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছেন, সেটা নিশ্চিন্তে প্রদানের অধিকারও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক উদবাতুল বারীর সভাপতিত্বে সম্মেলনে উদ্বোধক হিসেবে বক্তৃতা করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু। বেলা তিনটার দিকে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়।
উদ্বোধকের বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বরকত উল্লা বুলু বলেন, ‘নোবেল পাওয়ার পর শেখ হাসিনা আপনাকে সম্মান করেননি, আপনাকে সম্মাননা দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আপনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। আপনি আপনার সম্মানটুকু রক্ষা করুন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে যেভাবে সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন, সেভাবে সবাই আপনাকেও স্মরণ করবেন। তাই অতি দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ দিন। কারণ, নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমে আসবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্থিরতা কমে আসবে উল্লেখ করে বরকত উল্লা আরও বলেন, ‘আমরা সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দিই, কারণ ৫ আগস্ট তাঁদের অনেক সাহসী ভূমিকা ছিল। ওয়াকার সাহেব, আপনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দিয়েছেন। আপনি ড. ইউনূস সরকারকে সহায়তা করে দ্রুত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন—এটাই আজকের সম্মেলন থেকে আমাদের সবার দাবি।’
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ইউসুফ মোল্লার সঞ্চালনায় সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির কুমিল্লা অঞ্চলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিম ভূঁইয়া, বিএনপির কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক জাকারিয়া তাহের, বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক আমিন উর রশিদ এবং সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির এটি প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হলেও এর আগে আনুষ্ঠানিক কোনো সম্মেলন হয়নি। ২০২২ সালের ৩০ মে প্রথমবারের মতো কুমিল্লা মহানগর বিএনপির ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কেন্দ্র। এতে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আমিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক এবং কুমিল্লা মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লাকে সদস্যসচিব করা হয়। ওই কমিটি ঘোষণার তিন মাসের মাথায় প্রথম কমিটিকে বিলুপ্ত করে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উদবাতুল বারীকে আহ্বায়ক ও ইউসুফ মোল্লাকে সদস্যসচিব করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট কুমিল্লা মহানগর বিএনপির আরেকটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
প্রথমবারের মতো সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণের পর থেকেই আলোচনা ছিল, দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের ভোটে কারা নির্বাচিত হবেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিন পদে একজন করে মনোনয়ন দাখিল করায় সম্মেলনের আগেই নির্ধারণ হয়ে যায় কুমিল্লা মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সম্মেলন অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শীর্ষ তিন পদে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন সভাপতি পদে মহানগর বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক উদবাতুল বারী, সাধারণ সম্পাদক পদে মহানগর বিএনপির বর্তমান সদস্যসচিব ইউসুফ মোল্লা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজিউর রহমান।