মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
ব্যায়ামকে সংজ্ঞায়িত করা হয় শরীরের যে কোন সক্রিয়তাকে যা আপনার পেশীসমূহকে সক্রিয় করে এবং আপনার শরীরকে প্রয়োজনীয় ক্যালোরি বার্নের উপযোগী করে তোলে।
ব্যায়ামের রয়েছে আশ্চর্য রকম সব উপকার, যা আপনার স্বাস্থ্যের ভেতর থেকে বাহির প্রায় প্রতিটি দিক উন্নত করতে পারে। নিয়মিত শরীরচর্চা হরমোন উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যার ফলে আপনি উৎফুল্ল বোধ করতে পারেন এবং আপনার ভাল ঘুম হবে।তাছাড়া, এটি আপনার ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে, ওজন কমাতে, ওজন বৃদ্ধি বন্ধ রাখতে, ক্রনিক রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং আপনার যৌন জীবন উন্নত করতে সাহায্য করবে। ব্যায়াম বা শারীরিক সক্রিয়তার অনেক ধরন রয়েছে, যেগুলোকে আমরা সাঁতার, দৌড়, জগিং, হাঁটা ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকি। ব্যায়ামের শারীরিক-মানসিক বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে; এমনকি এর মাধ্যমে দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়।
এখানে ব্যায়াম বা শরীরচর্চার কয়েকটি শারীরিক ও মানসিক গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
১. মন ভাল থাকে:
ব্যায়ামের সবচেয়ে বড় উপকার হল মন ভাল থাকা। এটি আপনার মুড বা মেজাজ উন্নত করে এবং বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কমায়। এটা মস্তিষ্কের যে অংশ মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে ইতিবাচক পরিবর্তন তৈরি করে। এছাড়া এটি মস্তিষ্কের হরমোন সেরোটোনিন এবং নরপাইনফ্রাইন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে, যা বিষণ্নতার অনুভূতি উপশম করে।
এছাড়া, ব্যায়াম মানুষের উদ্বেগের উপসর্গ কমাতেও সাহায্য করে। এটি রোকদেরকে তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হতে এবং উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
মজার ব্যাপার হল, মুড ভাল রাখার জন্য আপনি কতটা তীব্রতায় ব্যায়াম করলেন সেটা কোন ব্যাপার নয়। যে কোন তীব্রতার ব্যায়াম করেও আপনি আপনার মুড ভাল করার সুবিধা নিতে পারেন।
২. ওজন কমে
ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতার মূলে রয়েছে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। এটি গবেষণায় প্রমাণিত। ওজন কমানোর ব্যাপারে ব্যায়ামের প্রভাব বুঝতে হলে ব্যায়াম এবং এনার্জি খরচের সম্পর্ক বুঝা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শরীর এনার্জি ব্যয় করে তিনটি উপায়ে: খাদ্য হজম করতে, ব্যায়ামের সময় এবং দেহের কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে, যথা-হার্টবিট এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে।
আপনি যখন ওজন কমানেরা জন্য ডায়েট কনট্রোল করতে চান, তখন আপনি ক্যালরি গ্রহণ হ্রাস করার মাধ্যমে ডায়েট করেন, এটি আপনার মেটাবলিক রেটা বা বিপাকিয় হার কমিয়ে দেয়। মূলত, এটি আপনার ওজন হ্রাসকে আরো বিলম্বিত করে দিবে। বরং আপনি যদি নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাহলে আপনার মেটাবলিক রেট বাড়িয়ে দিবে, যা আপনার অধিক পরিমাণে ক্যালরি বার্ন করবে এবং আপনাকে ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
৩. ব্যায়াম পেশী এবং হাড়ের জন্য ভাল
ব্যায়াম শক্তিশালী পেশী এবং হাড় গঠন এবং তা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন ভারোত্তালনের মত শারীরিক কার্যকলাপের সাথে পর্যাপ্ত প্রোটিনযুক্ত খাবার (প্রোটিন শেক) খাওয়া হয়, তখন পেশী গঠন জোরদার হয়।
এটা এ কারণে হয়, ব্যায়াম হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা আপনার মাংসপেশির এ্যামিনো এসিড শোষণের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি পেশির বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে ভাঙ্গন কমাতে সাহায্য করে।
মানুষের যখন বয়স হয়, তখন তাদের শরীরে পেশীভর এবং তার ফাংশন হ্রাস পাওয়ার একটি ঝোঁক তৈরি হয়, যা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া এবং অক্ষমতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই বয়স বাড়ার সাথে পেশীভরের ঘাটতি কমাতে এবং শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা অপরিহার্য। অধিকন্তু, তরুণ বয়সে ব্যায়াম হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে এবং বৃদ্ধ বয়সে অস্টিওপরোসিস রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
তবে, জিমন্যাস্টিক বা দৌড়ের মত হাই-ইমপ্যাক্ট এক্সারসাইজ অথবা ফুটবল বা বাস্কেট বল খেলায় হাড়ের ঘনত্ব সাঁতার বাং সাইক্লিংয়ের মত অপ্রভাব খেলার তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়।
৪. শক্তি বৃদ্ধি করে
ব্যায়াম বা শরীরচর্চা স্বাস্থ্যবান এবং স্বাস্থ্যহীন উভয় শ্রেণির মানুষের প্রকৃত এনার্জি বুস্টার বা শক্তি বৃদ্ধিকারী।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ক্রমাগত ক্লান্তি বা অবসাদে ভুগছেন এমন ৩৬ জন স্বাস্থ্যবান মানুষ নিয়মিত ছয় সপ্তাহ ব্যায়াম করায় তাদের ক্লান্তির অনুভূতি কমে যায়।
৫. দীর্ঘস্থায়ী অসুখে পড়ার ঝুঁকি কমায়
দীর্ঘস্থায়ী অসুখে পড়ার একটি প্রাথমিক কারণ হল নিয়মিত ব্যায়াম না করা। নিয়মিত ব্যায়ামে শরীরে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা ও কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস বৃদ্ধি পায় এবং শারীরিক গঠন উন্নত হয়। এছাড়াও নিয়মিত শরীরচর্চায় রক্তচাপ এবং রক্তে চর্বির মাত্রা হ্রাস পায়।
এছাড়া পেটের চর্বি কমাতে এবং শরীরে বাড়তি মেদের কারণে সৃষ্ট নানা অসুখের ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম করা খুবই জরুরী।
৬. ত্বকের স্বাস্থ্য ভাল রাখে
আপনার শরীরে যদি অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে এর একটি প্রভাব আপনার স্কিনে পড়বে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তখনই হয়, যখন আপনার দেহের এন্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা পুরোপুরিভাবে কোষের মধ্যে ফ্রি রেডিকেলস জনিত ড্যামেজ সাড়িয়ে তুলতে না পারে।এর ফলে ত্বকের কোষের আভ্যন্তরিণ অবকাঠামো ধ্বংস হতে পারে এবং আপনার ত্বকের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে।
যদিও কঠোর এবং পরিপূর্ণ ব্যায়াম আপনার অক্সিডেটিভ ধ্বংসে ভূমিকা রাখতে পারে, নিয়মিত সহনশীল বা মাঝারি ধরনের শরীরচর্চা আপনার শরীরে প্রাকৃতিকভাবে এন্টিঅক্সিডেন্ট উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে, যা আপনার কোষকে সুরক্ষা দিবে।
একইভাবে শরীরচর্চা রক্তপ্রবাহকে বেগবান করে এবং স্কিন সেলকে সজিব রাখে, যার ফলে ত্বকের উপর বয়সের ছাপ কম পড়ে।
৭. মস্তিষ্ক এবং স্মরণ শক্তি ভাল রাখে
শরীরচর্চা ব্রেনের ফাংশন উন্নত করে, স্মরণশক্তি ভাল রাখে চিন্তার দক্ষতা বাড়ায়। এটি হার্ট রেটও বৃদ্ধি করে যা রক্তপ্রবাহ এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ বেগবান করে। এছাড়া ব্যায়াম হরমোন উৎপাদনও জোরালো করে যা মস্তিষ্কের সেল বা কোষ বৃদ্ধিকে জোরালো করে। তাছাড়া যে সমস্ত দীঘস্থায়ী অসুখের কারণে ব্রেন আক্রান্ত হয়, নিয়মিত ব্যায়ামের কারণে সেসব ক্রনিক ডিজিজ থেকে বেঁচে থাকা যায়।
বয়স বাড়লে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং ব্যাথা- বেদনার যে ঝুঁকি থাকে, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় একটা পরিবর্তন ঘটায়, নিয়মিত ব্যায়ামের কল্যাণে তা থেকে বেঁচে থাকা যায়।
নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের আকৃতি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এটি মস্তিষ্কের সেই অংশ, যা স্মৃতি এবং শিক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সর্বশেষ, নিয়মিত ব্যায়াম আলঝেইমার এবং সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কমায়। কারণ ব্যায়ামের ফলে বয়সকালীন মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ঝুঁকি কমে যা এই দুটো অসুখের জন্য দায়ী।
৮. প্রশান্তি এবং ভাল ঘুম আনতে সাহায্য করে
নিয়মিত ব্যায়ামে মনে প্রশান্তি আসে এবং ভাল ঘুম হয়। আর ব্যায়ামের সময় যে শক্তি ব্যয় হয়, তা ঘুমের সময় ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া, ব্যায়ামের সময় শরীরের যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, ঘুমের সময় এই তাপমাত্রা কমে এবং এর ফলে ঘুমের মান ভাল হয়।
ঘুমের উপরে ব্যায়ামের প্রভাব বিষয়ে বহু গবেষণায় এসব সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি সপ্তায় ১৫০ মিনিট মাঝারি থেকে শক্তিশালী ব্যায়াম করলে ঘুমের মান ৬৫% পর্যন্ত উন্নত করা যায়।
১৬ সপ্তাহ’র আরেকটি গবেষণায়ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘুমের মান বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। এমনকি, দীর্ঘদিন নিদ্রাহীনতা বা ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন এমন ১৭ জন ব্যক্তিকে ব্যায়াম থেরাপি দিয়ে ভাল ফল পাওয়া গেছে, তারা গভীর ঘুম উপভোগ করতে পেরেছেন এবং এর ফলে তারা দিনের বেলা অনেক শক্তি অনুভব করতে পেরেছেন।
অধিকন্তু, তরুণ-যুবক বয়সে নিয়মিত ব্যায়াম করলে বৃদ্ধ বয়সে সুবিধা পাওয়া যাবে। বিশেষত, যখন ঘুম রোগে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
ব্যায়ামের ধরনের ব্যাপারে ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নেই। এ ব্যাপারে আপনি নমনীয় হতে পারেন এবং যে কোন একটি ধরন বেছে নিতে পারেন। আপনি ইচ্ছা করলে একা একা অথবা সম্মিলিতভাবে এরোবিক বা রেসিস্টেন্স ট্রেইনিং ব্যায়াম করতে পারেন। উভয় ব্যায়ামের মাধ্যমেই সমানভাবে গভীর ঘুম উপভোগ করতে পারবেন।
৯. ব্যাথা থেকে নিষ্কৃতি লাভে সাহায্য করে
ঔষধ সেবন কিংবা বিশ্রামের মাধ্যমে ক্রনিক পেইনকে দুর্বল করা যায়, কিন্তু সত্যিকার নিরাময় পাওয়া যায় ব্যায়ামের মাধ্যমে। বস্তুত, বহু বছর যাবৎ ক্রনিক পেইনের চিকিৎসায় বিশ্রাম এবং নিষ্ক্রিয় থাকারই পরামর্শই দেয়া হতো; কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরচর্চাই ব্যাথা থেকে মুক্তি লাভে বেশি সাহায্য করে।এ সংক্রান্ত কয়েকটি গবেষণা নিয়ে একটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রনিক ব্যাথায় ভুগছেন এমন কয়েকজনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শরীরচর্চার মাধ্যমে তারা ব্যাথা থেকে মুক্তি লাভ করেছেন এবং তাদের জীবন মান উন্নত হয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, ব্যায়াম দীর্ঘস্থায়ী লো ব্যাক পেইন এবং কাঁধের দীর্ঘস্থায়ী নরম টিস্যুর ব্যাধি সহ বিভিন্ন ব্যাধির সাথে সম্পর্কিত ব্যাথা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
উপরন্তু, ব্যায়াম ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াতে এবং ব্যথা উপলব্ধির অনুভূতি হ্রাস করতে সাহায্য করে।
১০.উন্নত যৌনজীবন লাভে সাহায্য করে
শরীরচর্চা উন্নত যৌনজীবন লাভে সাহায্য করে। এটি প্রমাণিত। কারণ, নিয়মিত ব্যায়াম করলে কার্ডিও ভাসকুলার সিস্টেম শক্তিশালী হয়, ব্লাড সার্কুলেশন উন্নত হয়, পেশীর দৃঢ়তা এবং নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়।
শরীরচর্চা যৌন-কর্মক্ষতা এবং যৌন সন্তুষ্টি সহ যৌনকর্মের হার বাড়াতে সাহায্য করে।
চল্লিশ বছর বয়সী একদল নারী লক্ষ করেছেন, তারা যখন তাদের জীবনধারায় স্প্রিন্ট, বুট ক্যাম্প এবং ওয়েট ট্রেনিংয়ের মত অধিক শ্রমসাধ্য ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত করলেন তখন থেকে তারা বেশি বেশি যৌন উত্তেজনা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন।
এছাড়া ১৭৮ জন স্বাস্থ্যবান লোকের উপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তায় কয়েক ঘন্টা ব্যায়াম বেশি করেছেন তারা যৌনকর্মে অধিক সাফল্য লাভে সক্ষম হয়েছেন।
৪১ জন পুরুষের উপর পরিচালিত আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, তারা শুধুমাত্র নিজেদের বাড়ীর চারপাশে প্রতিদিন রুটিন করে ৬ মিনিট হাঁটাহাঁটি করে তাদের উত্থানজনিত সমস্যার ৭১% হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন।
যারা বসে বসে কাজ করেন এমন ৭৮ জনের উপর পরিচালিত আরেকটি গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তায় গড়ে সাড়ে তিন ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করায় তাদের যৌনক্রিয়া, পুনরাবৃত্তি এবং সন্তুষ্টি সহ যৌন আচরণ উন্নত করতে সক্ষম হয়েছেন।
পিবিএ/এমএএইচ