পিবিএ ডেস্ক; বারোটা বাজাচ্ছে স্বাস্থ্যের মাসে দেড়শো গ্রামের বেশি প্লাস্টিক ঢুকছে আমাদের শরীরে। কখনও থাইরয়েডের মতো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর কাজকর্মে বিপর্যয় আনছে। আবার কখনও প্লাস্টিকের বিষ অকেজো করে ফেলছে ফুসফুস, ক্ষুদ্রান্ত্র। সম্প্রতি বারাকপুরের ‘সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এই ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ্যে এনে হইচই ফেলে দিয়েছে।
সত্যিই ভয়ংকর! কারণ, এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক বা মাইক্রো প্লাস্টিককে আলাদা করার কোনও ফিল্টার এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি বিজ্ঞান। ভয়ংকর অভিশাপ হয়েই সভ্যতার শিরা-উপশিরায় ভেসে বেড়াচ্ছে এই ন্যানো প্লাস্টিক। বিশ্বময় গবেষণা চলছে। এর উৎস কী? কেউ বলছেন, পেট জার, কেউ বলছেন ক্যারি ব্যাগ। কেউ বলছেন মাটিতে মিশে থাকা প্লাস্টিক। কলকাতার বাতাসে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি এখনও সেভাবে ধরা পড়েনি। তবে জলে এই বিষের উপস্থিতি প্রমাণিত। ‘সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর রিপোর্ট বলছে, কলকাতার পানীয় জলে মাইক্রো প্লাস্টিক ভয়ংকর মাত্রায় মিশে আছে। হিসাব বলছে, একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫ গ্রাম মানে, মাসে প্রায় দেড়শো গ্রাম মাইক্রো প্লাস্টিক খাচ্ছে। প্রায় ৭৫ হাজার প্লাস্টিক কণা শরীরে ঢুকছে। কোনও ফিল্টারের ক্ষমতা নেই এই বিষকে আলাদা করে ছেঁকে দেওয়ার। রক্তে বিষাক্ত কিছু মিশলে তা যাতে ব্রেনে পৌঁছতে না পারে, তার জন্য ‘ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার’(বিবিবি)বড় ভূমিকা নেয়। প্রসূতির শরীরে ঢোকা কোনও অ্যান্টিবায়োটিক যাতে ভ্রূণের ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্যও বিবিবি কাজ করে। বিবিবি-কে তাই ব্রেন এবং প্লাসেন্টার পাহারাদার বলা হয়। এই মাইক্রো প্লাস্টিক এত সংঘাতিক যে, বিবিবি-ও আটকাতে পারে না। এই কারণেই মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে এত মাথাব্যথা। বিশ্বজুড়ে হইচই।
তাহলে কি প্লাস্টিককে সমাজ-সভ্যতা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে? বিশেষজ্ঞরা কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন প্লাস্টিক ব্যবহারকারীদের। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, প্লাস্টিকের কোনও দোষ নেই। এটি সস্তা। কিছু ক্ষেত্রে বিকল্প নেই। ‘এমিশন ফুটপ্রিন্ট’ কাপড় বা কাগজের থেকে অনেক কম। আসল খলনায়ক প্লাস্টিকের অবৈজ্ঞানিক ‘ডিসপোজাল’। সেই কারণেই বিভিন্ন পুনঃচক্রায়িত পদার্থের সঙ্গে প্লাস্টিক ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হয়েছে। তবে অনুতাপের বিষয়, মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে ভারতে কোথাও তেমন কোনও কাজ এখনও শুরু হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথ বোস ল্যাবরেটরির সঙ্গে জুটি বেঁধে একটি ‘সেন্সর’ তৈরির চেষ্টা করছে ‘সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট’ (সেফ), যা জলে মিশে থাকা মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি জানান দেবে। মাস চারেক হল প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। গবেষণার অগ্রগতি সন্তোষজনক। সফল হলে মাইক্রো প্লাস্টিকের উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা অনেকটাই কাটবে। বর্তমানে ‘রমণ স্পেকটোমেট্রি’ দিয়ে মাইক্রো প্লাস্টিককে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু জল থেকে এই বিষকে আলাদা করার তেমন কোনও প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি। সমুদ্র উপকূলে সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্র বসিয়ে মাইক্রো প্লাস্টিক আলাদা করার একটা চেষ্টা অবশ্য শুরু করেছে জার্মানি।
আসলে মাইক্রো প্লাস্টিক হল ন্যানো পার্টিকল। খালি চোখে দেখা যায় না। প্লাস্টিক গলে না ঠিকই, কিন্তু প্লাস্টিক ভঙ্গুর। ভাঙতে ভাঙতে ন্যানো পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনই পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞদের। মাইক্রো প্লাস্টিক শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। গবেষণায় দ্যাখা গিয়েছে, মিউকাস মেমব্রেন বা ঝিল্লিতে আটকে গিয়ে বিরাট বিপদ ডেকে আনতে পারে মাইক্রো প্লাস্টিক। প্রথমে ‘ইরিটেশন’ তৈরি করবে। তারপর টিউমার। যা ম্যালিগন্যান্টও হতে পারে। যদি হাওয়ায় মাইক্রো প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফুসফুস। ‘লাং কনজেশন’ হতে পারে। অথচ কোনও প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখে বুঝতে হবে। মাইক্রো প্লাস্টিক যদি আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছে যায়, তাহলে মাইক্রো ভিলাইয়ের খাদ্যশোষক ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেবে। যা খাবে, তা-ই বদহজম হয়ে যাবে। রোগ নির্ণয় করতে না পেরে ডাক্তারবাবু ভুল চিকিৎসা করবেন। কেউ ক্যানসারের, কেউ অ্যালার্জির। এমন অনেক ঘটনাই প্রকাশ্যে এসেছে। জানা গিয়েছে, মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। বিশেষ করে থাইরয়েডের গ্রন্থির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
পিবিএ/এএম