নেলসন ম্যান্ডেলা গণতন্ত্র ও ন্যায়ের প্রতীক

alok

লেখক: অলোক আচার্য ,
”আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সকল ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগ লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান,যার মধ্যে দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি,কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ,যদি প্রয়োজন পরে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত”। এই কথাগুলো এমন একজন মানুষের যে তার জীবনের সব শক্তি দিয়ে বৈষম্য,ভেদাভেদ,অগণতান্ত্রিক পরিবেশ,বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বিশেষ করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ায়ের একজন সাহসী নেতা হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। বর্ণবাদ বলতে মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ সময়ের শেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গর মধ্যেকার ব্যাপক ভেদাভেদ বোঝানা হয়। তবে বর্ণবাদ দ্বারা সেই দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাজ বোঝানো হয় যেখানে কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্যই উঁচু-নিচু,বা কতৃত্ববাদ এবং ব্যাপকভাবে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠিকে সুবিধা দেয়া বা বঞ্চিত করা বোঝানো হয়। শরীরের রংয়ের ভেতরই কেবল এই ভেদাভেদ সীমাবদ্ধ নেই। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার শে^তাঙ্গশাসিত সরকার পৃথকীকরণ যা আপার্টহাইট নামে পরিচিত এবং এই পৃথকীকরণ নীতিতে কৃষ্ণাঙ্গ,শেতাঙ্গ,দক্ষিণ এশিয় বা বর্ণসংকর এসব বর্ণে ভাগ করে অশে^তাঙ্গদের বাসস্থান,নির্বাচনের অধিকার,যাতায়াতের অধিকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকারসহ নানাভাবে বেষম্যমূলক আচরণ করে। এ সব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের প্রতীক ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি এ বিশে^র এক মহান আদর্শিক নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৬৪ সালে রিভোনিয়া ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলাকালে প্রদান করা বক্তৃতায় তিনি এসব বলেন। তার আরও মূল্যবান বক্তব্য থাকলেও এই একটি কথাতেই তিনি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করার দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন।
দক্ষিন আফ্রিকার মহান এই নেতা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। পৃথিবীতে যুগে যুগে সাদা চামড়া-কালো চামড়া নিয়ে বিভেদ চলে এসেছে। আজকের এই প্রগতিশীল পৃথিবীতেও এই বৈষম্য রয়ে গেছে। নেলসন ম্যান্ডেলা এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন সাদা চামড়ার মানুষদের ছিল আধিপত্য। বিপরীতে কালোদের প্রতি পদক্ষেপে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। তিনি এমন একটি দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে একসাথে থাকতে পারে। তার সারা জীবন তিনি এই আদর্শ নিয়েই লড়াই করে গেছেন। ইতিহাস তাকে তাই দিয়েছে রাজার আসন। স্কুলের এক শিক্ষক তার নাম রেখেছিলেন নেলসন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ’মাদিবা’। ম্যান্ডেলা সারা বিশ্বের গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক। ম্যান্ডেলা তার পরিবারের প্রথম সদস্য যে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ম্যান্ডেলার রাজনীতিতে জড়িত হন তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর সুবাদে। মাহাত্না গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাব ছিল তার ওপর। তিনি অহিংস নীতিতে বিশ^াস করতেন। এভাবে আন্দোলনে জড়িয়ে পরার ফলে তিনি শে^তাঙ্গবাদী সরকারের বিরাগভাজন হন এবং ১৯৫৬ সালে তাকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। তবে তার মুক্তির পর তিনি অহিংস আন্দোলন থেকে সরে এসে বর্ণবাদ সরকারকে হটাতে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিকল্পনা করেন।
তিনি জানতেন বর্ণবাদী সরকারকে হটাতে আর কোনো উপায় নেই। এএনসি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। এই দীর্ঘ কারাজীবন ম্যান্ডেলার জীবনের দুঃসহ সময়। তাকে দেয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রুবেন দ্বীপে। তাকে কারাবন্দী করলেও বর্ণবাদ সরকার স্থির থাকতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতেই থাকে। কৃষ্ণাঙ্গ যুবকরা সেসব আন্দোলনে প্রাণ হারান। নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারাবাস দেয়ার পরপরই তাকে মুক্তির জন্য শেতাঙ্গ সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এভাবে কেটে যায় ২৭ বছর। এই দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৯০ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে দেয়া বক্তৃতায় ম্যান্ডেলা তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে আবারো বলেন, তিনি সেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে তার বিচারের থাকতে পারবে’। অর্থাৎ তিনি একটি বৈষম্যহীন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন। কারাগারে কষ্ট সহ্যকরাকালীনও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। মুক্তির পর ম্যান্ডেলার সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার চ্যালেঞ্জ। পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে নতুন করে বৈষম্যহীন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। তিনি সাবেক শেতাঙ্গদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন যারা একসময় তার ওপর হিংস্রাত্বক ব্যবহার করেছিল। এরপর ১৯৯৪ সালে আসে সেই সময় যেদিন দক্ষিন আফ্রিকার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে বেছে নেয় তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। জনগণের বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক জীবনের মতো তার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তিনি তার সারা জীবনই নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। তাই অবসরে যাওয়ার পরেও তার এই ব্যস্ততা থামেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চেষ্টা করেছেন মানুষের পাশে থাকতে।

পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...