পরিবর্তনে টালমাটাল দক্ষিণ এশিয়া

আসিফ হাসান: অপ্রত্যাশিত একের পর এক পরিবর্তনে টালমাটাল হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়া। এমন সব পরিবর্তন এখানে ঘটছে, যা কিছু দিন আগেও কেউ কল্পনা পর্যন্ত করতে পারেনি। আর কেবল জাতীয় রাজনীতিতেই নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর স্থায়ী প্রভাব দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এসব পরিবর্তন কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব টানাপড়েনেই হচ্ছে, তা নয়, বরং খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে অনেক দূর থেকে কারো কারো ঘুঁটি চালাচালিও এর পেছনে সক্রিয় ছিল। এসব ঘটনা ঘরোয়া রাজনীতির পরিণাম হলেও এতে ভূরাজনৈতিক মাত্রাও আছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান, ভুটান ও মালদ্বীপের নির্বাচনের ফলাফল হয়েছে ঘটনাপ্রবাহের বিপরীত। একইভাবে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার লড়াই ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনেককে বিস্মিত করেছে।
গত জুলাই মাসে পাকিস্তানে তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটিতে দু’টি দলের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটে। যে দলটি কিছু দিন আগেও ছিল অনেক পেছনের দিকে, তারাই এখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে। কয়েক বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি যে মুসলিম লীগ (এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে (পিপিপি) বিদায় করে ইমরান খান ক্ষমতায় আসতে পারবেন।


আগে ক্ষমতাসীন দুই দলের দুর্নীতি ও অপশাসনই ইমরান খানকে জয়ী হতে সহায়তা করেছে। দাবি করা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব থাকা সেনাবাহিনীও ইমরান খানের জয়ে ভূমিকা পালন করেছে।

পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল তাদের দুই দেশের জন্যই নয়, সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্রবিষয়ক বিষয়াদিতে ইমরান খানের অনভিজ্ঞতার কারণে এখন তিনি ভারতের ব্যাপারটি কিভাবে সামাল দেন, তাই দেখার বিষয়। দুই দেশের মধ্যে প্রধান বিবদমান বিষয় হলো কাশ্মির ও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ। এসব ব্যাপারে ইমরান খানকে নরেন্দ্র মোদি কোনো ধরনের ছাড় দেবেন বলে মনে হয় না।

পাকিস্তান অর্থনৈতিক জটিলতাতেও পড়েছে। অর্থ সঙ্কট কাটাতে ইমরান খানকে চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ছুটতে হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের আর্থিক সহায়তা হ্রাস করবেন।

ভূরাজনৈতিক জটিলতার ফলে যেটি ঘটতে পারে তা হলো পাকিস্তানে চীনা প্রভাব বৃদ্ধি। নির্বাচনের আগে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে সমালোচনা করতেন ইমরান খান। তিনি একে ঋণের ফাঁদ মনে করতেন। সিপিইসি চীনের কাছে কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যবহার করে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে পৌঁছাতে পারবে চীন। ফলে এই প্রকল্পটির প্রতি সর্বোচ্চ নজর থাকবে চীনের।

ভুটান : ভারত আউট, চীন ইন?
ভুটানের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন শেরিং তোগবির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিদায় ছিল অপ্রত্যাশিত। তারা অন্তত বিরোধী দলে থাকবে, তা ছিল নিশ্চিত। অন্য দিকে বিজয়ী ডিএনটিপি আগের নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি। তিন সপ্তাহ আগে লোতে শেরিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
ভুটানের এই নির্বাচনের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। গত বছর ভুটান-চীন-ভারত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দোকলামে চীন ও ভারত মুখোমুখি হয়েছিল। এই মালভূমির দিকে নজর রয়েছে ভারত ও চীনের। ভুটানের ঘরোয়া, অর্থনৈতিক, পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের বিপুল ভূমিকা রয়েছে। তবে চীন এখন ধীরে ধীরে তার অবস্থান সুসংহত করছে। আগের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রতি নমনীয় থাকলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রতি নির্ভরতা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে মনে হচ্ছে, ভারতের কক্ষপথ থেকে বের হয়ে যেতে পারে ভুটান।

মালদ্বীপে নির্বাচনী নাটকে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের জয়
মালদ্বীপে গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল ছিল সত্যিই হতবাক করা। কঠোর হাতে দেশ শাসনকারী প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন সহজেই আবার নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু সব হিসাব উল্টে স্বল্প পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলি হয়ে যান প্রেসিডেন্ট। গত কয়েক বছর ধরেই মালদ্বীপে ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব চলছিল। ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় উভয় দেশের জন্যই মালদ্বীপ আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। ইয়ামিন চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু এখন সব হিসাব বদলে গেছে। এখন মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মালদ্বীপের পক্ষে চীনকে দূরে সরিয়ে রাখা পুরোপুরি সম্ভব হবে না।

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বিপর্যয়
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে হটিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে বসিয়েছেন। কিন্তু রাজাপাকসে এখন পর্যন্ত পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারেননি। সিরিসেনা পার্লামেন্ট স্থগিত করলেও সুপ্রিম কোর্ট সেটিকে পুনর্বহাল করেছে। আবার বিক্রমাসিংহেও ক্ষমতা ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিছেন।
আঞ্চলিক ভূরাজনীতির দিক থেকে বিক্রমাসিংহে ভারতের প্রতি আর রাজাপাকসে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত। ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শ্রীলঙ্কার অবস্থান। এ কারণেও দেশটির প্রতি চীন ও ভারতের নজর রয়েছে।
দেশটি এখন যে সাংবিধানিক সঙ্কটে পড়েছে, তার পেছনেও এই পরাশক্তি দু’টির ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে মনে করে।

প্রয়োজন স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও গরিব অঞ্চল হলো দক্ষিণ এশিয়া। আবার এখানে ভারত-পাকিস্তান ও ভারত-চীন বৈরিতাও রয়েছে।
এই অঞ্চলের জন্যই নয়, এশিয়া ও সার্বিকভাবে বিশ্বের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যও স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া প্রয়োজন।
রাজনৈতিক বিরোধে না গিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার উচিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া। রাজনৈতিক টানাপড়েনের বদলে এটিই হওয়া উচিত তাদের প্রধান এজেন্ডা। সবার জন্য উইন-উইন পরিস্থিতি বিরাজ করলে তা সবার জন্যই কল্যাণকর হবে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও বের হতে পারবে অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপ থেকে। সাধারণ মানুষ যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়, যে সমৃদ্ধি কামনা করে তা পেতে পারবে।

আরও পড়ুন...