পিবিএ ডেস্ক: সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার শুরু করে এখন কর্পোরেট জগতে সফলতার সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করছেন মনোয়ারুল ইসলাম রিবেল। বর্তমানে ড্যাফোডিল পরিবারে মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস-এর ডিরেক্টর হিসেবে ডলফিন ডিজিটাল অ্যান্ড বিপিও , স্কিল জবস, ডলফিন সাইবার সিকিউরিটি সলিউশন, মার্কেটিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ওয়ান-কার্ড, ড্যাফোডিল মাল্টিমিডিয়াতে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি বহুমাত্রিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সফল এই তরুণ জানিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প। জানিয়েছেন দেশে টেকনোলজি ও মার্কেটিং সেক্টরে কিছু বিশ্বমানের দক্ষ কর্মী তৈরি করতে কাজ করছেন তিনি। তিনি মনে করেন, নিকট ভবিষ্যতে আমরা প্রযুক্তিতে বিশ্বে কেবল প্রতিনিধিত্বই করবো না নেতৃত্বও দেব।
রিবেল এর আগে এডিসন ফাউন্ডেশনের (এডিসন গ্রুপ) এর কো-ফাউন্ডার ও সিওও হিসেবে কাজ করেন সাফারা আইটি লিমিটেড, সাফারা এগ্রো, সাফারা মেশিনারিজ, সাফারা ইনফোটেক ও এডিসন ফাউন্ডেশনে।
এছাড়া তিনি আই ভেঞ্চার লিমিটেড ( ইমপ্রেস গ্রুপের একটি কনসার্ন) এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও পার্টনার হিসেবে কাজ করেন। যাদরো আইটি, যাদরো বিপিও, বেস্টওয়ে ডিজিটাল মিডিয়া লিমিটেড, এজিডি আইটি মালিয়েশিয়া সহ দেশি-বিদেশি একাধিক কোম্পানি পরিচালনায় সহ প্রতিষ্টাতা ও সিওও হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। সাংবাদিকতা করেছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, দৈনিক সমকাল, বার্তা২৪ সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এছাড়াও রিবেল মনোয়ার অনলাইন সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করা এদেশে প্রথম সংগঠন “বাংলাদেশ অনলাইন জার্নালিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন-বিওজেএ’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অনেক বছর সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে এ সংগঠনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, এরপর রয়্যাল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা থেকে মার্কেটিংয়ে বিবিএ ও এমবিএ করেছেন রিবেল। তিনি সুইজারল্যান্ডের একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্রাটেজিক মার্কেটিংয়ে পোস্ট প্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন। ডিপ্লোমা করেন মাল্টিমিডিয়া,কম্পিউটিং ও সাইবার সিকিউরিটিতেও। অধ্যয়ন করেছেন ফুটওয়্যার, এগ্রো ইকোনমিতে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন ফ্যাকাল্টি হিসেবেও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন এই তরুণ।
শৈশব ও কৈশোরের গল্প
আমাদের পরিবারে আমরা তিন ভাই এবং আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটি রুম সম্পূর্ণই লাইব্রেরি এবং আমার মা সব সময় আমাদের বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। হাজার হাজার বইতে আমাদের লাইব্রেরি ঠাসা। আমারকে মা’কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিলেন তুমি যদি এর উত্তর পেতে চাও তাহলে ডেল কার্ণেগি, ড. লুৎফর রহমান এদের বই পড়ো। তখন আমি এই ধরণের বই পড়া শুরু করলাম এবং তখন আমার কাছে মনে হতো প্রতিদিনই নতুন জীবন।
“আমার অনুভূতিতে আসলো, এতো দিন আমি ভুল জীবনাচারে অভ্যস্ত ছিলাম। জীবন শুধু খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়াই , জীবনের মানে আরো বৃহৎ। এই বইগুলো পড়া থেকে এই অনুভূতি আমার মধ্যে চলে আসলো।
একটি বইয়ের কথা এখনো মনে আছে, সেটি হলো “মোর বড় হতে চাই”। বইয়ের লেখক আহসান হাবিব ইমরোজ লিখেছিলেন, মানুষের মস্তস্কের ক্ষমতা সুপার কম্পিউটারের চেয়ে আড়াই হাজার গুণ বেশি। এবং আমরা পুরো জীবনে মস্তিস্কের মাত্র দশ ভাগ ব্যবহার করি। আর আইনিষ্টাইনের মতো মেধাবি মানুষরা মস্তিস্কের মাত্র ১২% ব্যবহার করেছেন। তখন থেকে মনে হলো আমাকে মস্তিস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং যতো চিন্তা করি বা পড়ি কখনো মাথায় চাপ পড়বে না। কারণ আমার মস্তিস্কের ক্ষমতা তো এর চেয়ে অনেক বেশি। এই বিশ্বাস থেকে বইপড়া শুরু করলাম এবং বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ জীবন কি সেটি বের করা শুররু করলাম। সেই অর্থে যদি বলেন তাহলে বলতে হয় ডেল কার্ণেগী, শিব খেরা, ডা. লুৎফর রহমান প্রমুখ লেখকের বইগুলো আমাকে পরিবর্তন করেছে এবং আমার ভেতরে পরিবর্তনের স্ফুলিঙ্গ সেখান থেকে সূচনা হয়েছে।
পড়াশোনা ও পরিবার
আমার পরিবারের দাদা, বাবা ও চাচারা উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা করছেন প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে। আমার দাদা আব্দুস সোবহান খন্দকার ওষুধের ব্যবসায় রংপুরে প্রসিদ্ধ ছিলেন। বাবার ওষুধের ব্যবসা, প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার ব্যবসা, কস্ট্রাকশন ব্যবসা। চাচাদের রাসায়নিক সারের ব্যবসা, রেস্টুরেস্ট, কৃষি ও চালের ব্যবসা এখনো বেশ বড় আকারে চলছে। ফলে পরিবার থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
তখন আমার মতো হলো আমাদের পরিবারের যে ঐতিহ্য রয়েছে তার উপর সুবিচার করা উচিৎ। যেমন আপনি জানেন একজন লোক খারাপ তারপরও আপনি যদি তাকে সালাম দেন তাহলে সেই লোক আপনার সাথে আর খারাপ কাজ করতে পারবে না। একে বলে নামের প্রতি সুবিচার। এজন্য মানুষের সাথে ভাল কথা বলতে হয়। এতে খারাপ লোকটিও একসময় ভালো কাজ করে। আমার তখন মনে হলো এই গুণ কেন কাজে লাগাচ্ছি না? এই ধরণের ব্যক্তিত্ব গড়ার সুযোগ তো আমার রয়েছে। বিসিএস বই পড়ার সাথে সাথে আমার চাচার ভূমিকা এই ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে। আমার মাও অনেক বই পড়তেন, তার উপদেশ এবং পরামর্শও আমার জীবনে অনেক কাজে লেগেছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে আমি যে শিক্ষাগুলো পেয়েছিলাম সেগুলো আমার জীবন গড়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমার পরিবার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় আর্থিক সাহায্য দিতে পারিনি কিন্তু তাদের শিক্ষা, উৎসাহ এবং প্রেরণা সব সময় আমার জীবনে আলোকর্তিকা হিসাবে আমাকে পথ দেখিয়েছে।
আপনি যদি আমাকে বলেন পরিবার থেকে আমি কি পেলাম তাহলে এক বাক্যে বলবো আমি বই পড়ার অভ্যাসটি পেয়েছি। আমাদের পরিবারের সকলেরই এই অভ্যস রয়েছে। ছুটিতে বাড়ি গেলেও সবাই আমারা বই পড়াতে অনেক সময় ব্যয় করি। আমার বাবা যখন ব্যবসা করতো তখন তার অফিসেও বই থাকতো। মনে আছে কাল পুরুষ নামে একটি উপন্যাস অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়তেন। আমার যে মেয়ে হয়েছে তাকেও বই পড়ার অভ্যাস করিয়েছি।
দুঃখের আর সুখের স্মৃতি ক্যারিয়ারে
বিভিন্ন সেক্টরের সফল ও মহৎ মানুষের সানিধ্যে আসার ফলে আমার মধ্যে বোধ জন্মাল যে, আমাদের জীবনের হিসাব পাল্টাতে হবে। প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা, প্রত্যেকটা মানুষই ইউনিক, প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে কাজ করা উচিৎ। সমাজের দেশের দোষ দেওয়া বেকার। কোথাও যদি কোন সমস্যা দেখি তবে আমারই দোষ মনে হয় কারণ এর সমাধান তো আমিই করে দিতে পারি। অন্যজনকে দোস দেওয়া সহজ, কিন্তু নিজের দোষ খুঁজে বের করা খুবই কঠিন।
আরেকটি বিষয় হলো আমি সেল্ফ মেড ম্যান নই। আমাকে অনেকে সাহয্য করেছে এই পর্যায়ে আসার পেছনে। ইউনির্ভাসিটির অনেক বড়ভাই আমাকে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের অনেক শীর্ষ ধনী যারা একসময় ইউনির্ভাসিটিতে লেখাপড়া করতেন তখন তাদের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারা যখন মাস্টার্সে পড়তো আমি তখন ফাস্ট ইয়ারে পড়তাম। দশ বছরের মধ্যে সেই বড়ভাইরাই দেশের ১০০ শীর্ষ ধনীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের সান্নিধ্য পাওয়াও আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল। তারা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিতেন এবং বলতেন এটি তোমার পক্ষে করা সম্ভব। আমি যখন কোন উদ্যোগ নিয়েছি তখন হয় সফল হয়েছি নাহলে শিখেছি। কখনো লোকসানের কিছু ঘটেনি আমার সাথে। এছাড়া ছোট বেলা থেকে আজ অবধি যে মানুষগুলোর সাহচর্য পেয়েছি তাদের প্রচেষ্ট, উৎসাহ ও কল্যাণ চিন্তার ফলে আজ আমার এই পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দিন হল আমার জীবনে অনেক বড় অবদান রেখেছে। সেখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।
উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
আমার জীবনে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে বেস্টওয়ে গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বড়
ভুমিকা রেখেছেন। সেখানে কর্মরত অবস্থায় আমি বেস্ট এমপ্লয়ি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম। তিনিই প্রথম আমাকে উৎসাহিত করেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এরপর এডিসন গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুর রশিদ, ইমপ্রেস গ্রুপ, ইনসেপটা ফার্মা ও চ্যানেল আইয়ের ডিরেক্টর জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন, ড্যাফোডিলের চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর সবুর খান আমাকে সরাসরি মেন্টরিং করে এগিয়ে দিয়েছেন।
এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিমউদ্দিন হলের উৎসব কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ক্লাবের ফাউন্ডার কমিটির প্রেস এর সেক্রেটারি হিসেবেও নিয়োজিত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিনানশিয়াল লিডারশিপ ক্লাবের কো-ফাউন্ডার ও জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন।
পুরস্কার বা প্রাপ্তি
সব থেকে বড় পুরস্কার ও প্রাপ্ত হলো কয়েক লক্ষ মানুষের সাথে তৈরি হওয়া সম্পর্ক। সাইবার সিকিউরিটি বিজনেস উদ্যোক্তা হিসেবে আমি ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার হতে অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছি। এছাড়াও আইটি উদ্যোক্তা হিসেবে ইনডেক্স অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ ইন্সটিউট অফ জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে বেস্ট ক্যারিয়ারিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।
আর কি কি করতে চান
ভবিষ্যতে আমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লকচেইন অ্যান্ড ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং রোবটিক্স নিয়ে কাজ করতে চাই। আর দেশে টেকনোলজি ও মার্কেটিং সেক্টরে কিছু বিশ্বমানের দক্ষ মানুষ তৈরি করতে কাজ করছি। এগ্রো সেক্টরেও বেশ কিছু উদ্যোগ চলমান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশেও টেসলা কোম্পানির মতো স্মার্ট কার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার এবং বায়োনিক স্যু, স্মার্ট স্যু ফ্যাক্টরি তৈরি করার। আর তরুণদের নিয়ে কাজ করতে চাই। কারণ তরুণরাই দেশের সম্পদ যারা দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে নিতে পারে উন্নত বিশ্বের কাতারে। আর নলেজ বেজড ইকোনমিতে সামনের সারিতে থাকতে চান তিনি।
পিবিএ/জেআই