মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
বিবাহ কোনো ক্ষণস্থায়ী এডভেঞ্চার নয়। এটি আজীবনের সম্পর্ক, একটি বলিষ্ঠ অঙ্গীকার যা আইনের মাধ্যমে সিদ্ধ এবং একটি গুরত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব।
পরিবারের সফলতার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করা অপরিহার্য। এগুলো হলো- প্রশান্তি, ভালোবাসা এবং ক্ষমা। প্রশান্তি বলতে আমি সুখ-শান্তি এবং আনন্দ আস্থাকে বুঝাতে চাই। একজন স্বামীর যেমন তার স্ত্রীর প্রতি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট থাকা প্রয়োজন, তেমনি একজন স্ত্রীরও প্রয়োজন তার স্বামীর প্রতি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকা। ভালোবাসা হলো এমন এক পারস্পরিক অনুভবের নাম যা সম্পর্ককে সুখময় ও আনন্দঘন করে তোলে এবং ক্ষমা হলো নারী ও পুরুষের চরিত্রের সকল সৎ গুণাবলীর ভিত্তি।
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের একটি আয়াতের উল্লেখ করা যায় যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহানবীকে (সা.) বলেন, ‘এটা আল্লাহর মেহেরবানী যে তুমি লোকদের সাথে সদয় ব্যবহার করো, তানাহলে তুমি যদি রুক্ষ আচরণ করতে এবং কঠিন হৃদয়ের অধিকারী হতে তাহলে তারা হতাশ হয়ে তোমার চারপাশ থেকে সরে যেত।’- [আল মায়িদা : ১৫৯]
ক্ষমা কোনো সাময়িক সহমর্মিতার অনুভূতি নয়; বরং এটি হচ্চে হৃদ্যতা, উচ্চ নৈতিক আদর্শ এবং সম্ভ্রম প্রবণতার অব্যাহত ফলগুধারার নাম।
প্রগাঢ় প্রশান্তি, ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার বন্ধনে যে শান্তির নীড় গড়ে উঠে তার কারণেই বিবাহ ফলপ্রসূ হয় এবং এটি পৃথিবীতে একটি আশির্বাদ দেখা দেয়। এ ধরনের পরিবার সমাজের যে কোনো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে সক্ষম এবং এ ধরনের পরিবারই জাতিকে সুসন্তান উপহার দিতে পারে। আমার মনে হয়, বেশিরভাগ শিশুদের মনে যে মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা, কষ্ট এবং নানাবিধ জটিল সমস্যা বিরাজ করছে তার জন্য দায়ী তাদের পিতা-মাতার মধ্যকার নরবরে সম্পর্ক এবং অব্যাহত ঝগড়ঝাঁটি।
কেউ হতো প্রশ্ন করতে পারেন, সুখী-সংসারের জন্য আবেগটাই কি সব, অর্থ-সম্পদ বা বস্তুগত উপায়-উপকরণ কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? না, আবেগটাই সব নয়। উপরে যেসব উপকরণগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর সাথে আরো কিছু উপকরণ যোগ করা প্রয়োজন যেগুলো সুখী-সংসার বা উত্তম পরিবার তৈরি করতে সাহায্য করবে।
এ প্রসঙ্গে মহানবীর একটি হাদীস আমাদের সাহায্য করতে পারে। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, ‘তিনটি জিনিস তোমাকে সুখী করতে পারে : এক. এমন এক স্ত্রী যাকে তুমি পছন্দ কর এবং বিশ্বাস কর যে সে তোমার অর্থকরি বা সম্পদের যতœ করবে এবং এমনকি তোমার অনুপস্থিতিতেও তোমার প্রতি তার আনুগত্য ও একাত্মতাকে অটুট রাখবে। দুই. এমন দ্রুতগামী বাহন যা তোমাকে তোমার বন্ধুদের সাথে সমানতালে চলতে সাহায্য করবে এবং তিন. একটি বড় বাড়ি, যাতে থাকবে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা। অনুরূপভাবে তিনজি জিনিস তোমাকে হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখতে পারে : এক. এমন স্ত্রী যাকে তুমি খারাপ মনে কর এবং যেসব সময় তোমাকে বাক্যবাণে জর্জরিত করে কষ্ট দেয় এবং তুমি যখন বাইরে থাকো তখন তার নিজের হেফাজত এবং তোমার অর্থকরির হেফাজতের ব্যাপারে তুমি তাকে বিশ্বাস কর না। দুই. তুমি বাহন হিসেবে ব্যবহার কর এমন এক অলস পশু যাকে ধাক্কা দিতে দিতে তুমি কাহিল হয়ে পড় এবং ধাক্কা না দিলে যে চলেই না। এবং তিন. খুবই ছোট বাড়ি, যাতে খুব একটা সুযোগ-সুবিধা নাই।’ আল আলবানি।
এটাই স্বাভাবিক যে, আমরা এমন কাজ করব, যেগুলো আমাদের সুখী করবে এবং যেগুলো আমাদের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করবে সেগুলো আমরা পরিহার করব বা এড়িয়ে চলব। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) আকেটি হাদীসে বলেছেন, ‘এমন কাজ কর যাতে তুমি লাভবান হও, আল্লাহর সাহায্য চাও এবং নিজেকে কখনও অসহায় মনে করো না।’ -মুসলিম।
ধর্ম কখনও মানুষের স্বাভাবিক মানবিক প্রয়োজনকে অগ্রাহ্য করে না। সুতরাং মানুষ কেন স্বস্তি, সন্তোষ এবং সুখী হওয়ার চেষ্টা করবে না। একটি বড় ও আরামদায়ক বাড়ির আকাক্সক্ষা করার অধিকার প্রত্যেক মুসলমানেরই রয়েছে, যা তাকে কাজ করতে এবং উৎপাদনমুখী হতে উৎসাহিত করবে। একইভাবে পরিবহনের অপর্যাপ্ততা, অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং দাজ্জাল জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনীকে অপছন্দ করার অধিকারও তার রয়েছে।
যখন কোনো নারী বা পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে আগ্রহী হয় তখন তার উচিত কাক্সিক্ষত পাত্র বা পাত্রী সম্পর্কে যথাসম্ভব খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যে তিনি যে ধরনের গুণাবলীর জুরি প্রত্যাশা করছেন তা প্রস্তাবিত পাত্র বা পাত্রীর মধ্যে বিদ্যমান আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। অন্যথায় দুঃখের আর শেষ থাকবে না। কেননা বিয়ের আগে অনেককেই অতিশয় মহামানব সাজতে দেখা যায়, কিন্তু বিয়ের পর দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। অনেককে আবার দেখা যায়, বিয়ের পূর্বে স্ত্রীকে যে পরিমাণ মোহরানা দেয়ার অঙ্গীকার করেন, পরবর্তীতে তারা আর সে অঙ্গীকার রক্ষা করেন না। আমাদের ধর্মে এ ধরনের দুর্বল চিত্তের লোকদের সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, স্ত্রীকে কম হোক বেশি হোক মোহরানা দিতেই হবে। কোনো ব্যক্তি যদি মোহরানা পরিশোধ না করার মতলব করে এবং অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও মোহরানা পরিশোধ না করে এবং এ অবস্থায় মারা যায়, তাহলে পরকালে সে একজন ব্যভিচারী হিসেবে আল্লাহর দরবারে হাজির হবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি কারো পাওনা পরিশোধ না করার মতলব করে এবং পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ না করেই মারা যায় তাহলে পরকালে সে একজন চোর হিসেবে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে বাধ্য হবে।-[আল আলবানী]
তবে কোনো স্ত্রী যদি মনে করেন যে তার স্বামী সত্যি সত্যিই একজন সজ্জন এবং অঙ্গীকার পূরণে আন্তরিক হওয়া সত্ত্বেও তা পূরণ করতে পারছে না এ অবস্থায় স্ত্রী যদি মোহরানার আংশিক বা পুরো অর্থ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেন সেক্ষেত্রে স্বামী বেচারা মাপ পেতে পারেন। তবে কিছু লোক আছে, যারা মনে করে যে, তাদের শুধু অধিকারই আছে কিন্তু কোনো দায়িত্ব নেই। অথচ স্বামীর যেমন অধিকার আছে স্ত্রীর ওপর, তেমনি স্ত্রীরও অধিকার আছে স্বামীর ওপর। কাজেই স্ত্রীর অধিকার বিষয়েও স্বামীকে যতœবান হতে হবে, তাহলেই সংসারে শান্তি আসবে।
একথা ঠিক ইসলামিক পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীর তুলনায় পুরুষের দায়িত্বের বোঝাটা একটু বেশি ভারি। পরিবারের নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বটা পুরুষের ওপর। সন্দেহ নাই সমাজ-সংগঠনের প্রতিটি স্তরেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, স্বামী কর্তৃত্ব জাহির করতে যেয়ে স্ত্রীর মতামত, তার সামাজিক বা অর্থনৈতিক সকল অধিকারকে পদদলিত করবেন।
সমাজে বিবাহিত নারী বা পুরুষের কিছু সুনির্দিষ্ট চারিত্রিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো নারী বা পুরুষের মধ্যে যদি সে ধরনের বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি থাকে তাহলে তার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়াই উচিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো নারী যদি কঠোর প্রকৃতির হন এবং তার মধ্যে যদি সহমর্মিতার লেশ মাত্রও না থাকে এবং অন্যের আবেগ যদি তার মধ্যে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়; তাহলে তার উচিত হবে বিবাহ না করা। কারণ তার পক্ষে ভালো স্ত্রী এবং মা হওয়া সম্ভব হবে না। মনে করুন, কোনো এক সময় যদি তার স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার সেবা করার জন্য যদি সেবিকাও ভাড়া করা না যায়, তখন তো স্ত্রীর উচিত হবে স্বামীর যথাযথ সুশ্রুসা করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এটিই সামাজিক বাধ্যবাধকতা।
আসলে ভালোবাসার মাপকাঠি আর পারস্পরিক স্বার্থের বাণিজ্যিক পাল্লা-পাথর এক নয়। শান্তির নীড় গড়ে উঠে যে ভালোবাসার ভিত্তি ভূমির ওপর তাকে স্বার্থের হিসাব-নিকাশ দিয়ে মেলানো যাবে না। তাই যদি হত তাহলে পরিবারের সুখ-শন্তির জন্য পুরুষরা যেমন তাদের জীবনপাত করতে পারত না, তেমনি কোনো নারীও পারত না স্বামী ও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সব সাধ-আল্লাদকে বিসর্জন দিতে।
পিবিএ/এএইচ