পাখির অভয়ারণ্য কালাইয়ের মোল্লাপাড়া

পিবিএ, জয়পুরহাট: ভ্যাপসা গরম ও মাঝে মাঝে বৃষ্টি। তাই আগেই মুঠোফোনে সহকর্মী রনি সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম। যাব জয়পুরহাটের কালাই সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মাত্রাই গ্রামে। উদ্দেশ্য ছিলো, সেখানে মোল্লাপাড়ার বাঁশবাগানে বিভিন্ন পাখিদের অভয়ারণ্য দেখব। বুধবার খুব সকালে দু-জনে বাইকে চড়ে রওনা দিলাম সেখানে। প্রায় তিরিশ মিনিটে সেখানে পৌঁছে গেলেম। সেই পাড়ায় একটু যেতেই পাখিদের কলরব কানে শুনতে পেলাম। সামনে এগুতেই দেখি বেশ কিছু পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। মোল্লাপাড়ার আশে-পাশে পুকুরপাড়ের বাঁশবাগানে এই পাখিদের বসবাসা। প্রায় ১০একর পাড়াজুড়ে বিভিন্ন বাঁশবাগান আছে। সেখানে ছোট-বড় মিলে আছে প্রায় ১০টি রেইনট্রিগাছ, ২০টি আমগাছ, ৬টি খেজুরগাছ, ৭টি নিমগাছ, ৫টি শিশুগাছ, ১০টি কাঁঠালগাছ ও ৪টি তালগাছ।

সেখানে বিলুপ্তপ্রায় কালো পানকৌড়ি, সাদা-বক, জ্যাঠা-বক, আম-বক, কানি-বক ও রাতচোরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির উপস্থিতিতে মোল্লাপাড়া এখন অপরূপ সুন্দর একটি পাড়া। সকালে পাখিগুলো ওড়ে আহারের জন্য আশপাশে খোলা মাঠে চলে যায়। আর সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসে নিজ কুটিরে। সেই পাড়ায় প্রায় ৬ বছর ধরে পাখিরা এখানে বসবাস শুরু করেছে। বছর বছর বেড়েই চলেছে পাখির সংখ্যা। সকাল-সন্ধ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির কোলাহলে মুগ্ধতা ছড়ায় মানুষের মনে।

ওই পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির বাঁশঝাড়, গাছ-গাছালি যেন পাখিদের এক একটি স্বর্গরাজ্য ও অভয়াশ্রম। পাড়ার চার পাশে শুধু পাখিদের কোলাহল ও কিচিরমিচির শব্দ। পান কৌরি, সাদা-বক, রাতচোর পাখিরা বাঁশের বা বিভিন্ন গাছের চূড়ায় বসে ডানা ঝাপটায়। আবার গাছের মাথার উপর দিয়ে দুই-এক চক্কর দিয়ে এসে গাছের চূড়ায় বসে। কোনটা গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে, আবার কোনটা বাঁশের এক কঞ্চি থেকে অন্য কঞ্চিতে, এক গাছ থেকে অন্য গাছে নির্বিঘ্নে উড়ে যেতে থাকে। পাখিদের বাসার ভেতর থেকে ছানাগুলো টেক টেক শব্দ করে ডাকছে। তাদের খাওয়াতে ব্যস্ত মা-পাখিরা। কোনোটি বাসা বাঁধছে আপন মনে, আবার কোনোটি ডিমে তা দিচ্ছে। নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না পাখির সঙ্গে মানুষের কতটা নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। এ পাড়ার মানুষ তাদের বন্ধুর ও সন্তানের মতো, তাই মানুষের সঙ্গে মিতালি তৈরি করে নিরাপদে ও খুব কাছাকাছি বসবাস করে পাখিরা। মোল্লাপাড়ার বাসিন্দাররা পাখিদের প্রতি ভালোবাসা তুলনাহীন।

তবে তাদের দাবি,সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই পাড়াটি গুরুত্বপূর্ণ পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিণত হবে বলে মোল্লাপাড়াবাসীরা জানান।
পাখিদের এই অভয়ারণ্য কত দিন ধরে আছে জানতে চাইলে মোল্লাপাড়ার মোফাজ্জল হোসেন ও মুনছুর রহমান জানান, প্রায় ২০১৪ সালের দিকে এই পাড়ায় বাঁশবাগানে ও বিভিন্ন ছোট-বড় গাছে এসে পাখিরা আশ্রয় নেয়। বেশ কয়েক মাস থেকে সংখ্যায় বেশি করে ফের ওরা চলে যায়। পরের বছর সংখ্যায় কমে নিয়ে আবার আসে। আবারও চলে যায় পাখিরা। তবে পাখিগুলো দেখতে খুবই ভালো লাগে তাদের। এরা দিন-রাত প্রায় সব সময় কিচিরমিচির করলেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না।

একই পাড়ার রবিউল ও মান্নান জানান, পাখিরা আশপাশের বাড়ির আম, রেইনট্রি, নিম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন গাছের অনেক নতুন ডাল এবং বাঁশের মাথা ভেঙ্গে ফেলছে। এদের বিষ্ঠার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এত যন্ত্রণার পরেও পাড়ার সবাই পাখিদের খুব ভালোবাসে। ঝড়-বৃষ্টি হলেই পাড়ার যুবকেরা ছুটে যায় বাঁশবাগানে। পাখির ছানা পড়ে থাকতে দেখলেই তাঁদের নীড়ে তুলে দিয়ে আসে। তারা পাখিগুলো কাউকে শিকার করতে দেই না। কারণ এদেরকে তারা খুব ভালোবাসেন।

মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান মন্ডল বলেন, সরকারি উদ্যোগে পাখি সুরক্ষার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই পাড়াকে পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। এতে করে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কালাই উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসার ডা. মো. আবু তালেব বলেন, উপজেলার মোল্লাপাড়া পাখি যেন কেউ শিকার করতে না পারে সে বিষয়ে আমরা সচেতনতামূলক কাজ করছি। পাখির সুরক্ষার বিষয়ে প্রাণী সম্পদ অফিস দেখভাল করছেন।

পিবিএ/আবু বকর সিদ্দিক/এসডি

আরও পড়ুন...