পানিবাহিত রোগ: কীভাবে বুঝবেন, কী করবেন

পিবিএ ডেস্কঃ আমাদের দেশে গ্রামের এবং শহরের পানির ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রাম বাংলায় অনেক মানুষ পুকুর, ঝিল, কুয়োর পানি পান করেন। সমস্যা হল, বৃষ্টির কারণে মল, মূত্র অন্যান্য আবর্জনা এসে এই পানীয় পানির উৎসে মেশে। পানি সংক্রামিত হয়। এবার সেই অপরিশোধিত পানি পান করলে মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক।

অন্যদিকে শহরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাইপের মাধ্যমে পানীয় পানি পৌঁছে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত নদীর পানিকে বিভিন্ন উপায়ে পরিশোধিত করে মানুষের কাছে পানি পৌঁছানো হয়। ফলে এই পানিতে সংক্রমণের আশঙ্কা তুলনায় অনেকাংশে কম। তবে এক্ষেত্রেও পানি পরিশোধনে খামতি থাকলে সমস্যা হতে পারে। কারণ এখন দেশের বেশিরভাগ বড় নদীই দূষণের শিকার। এবার কোনও কারণে সেই নদীর সংক্রামিত পানি সঠিক পদ্ধতিতে পরিশোধিত না করে মানুষের বাড়ি পৌঁছে গেলেই সমস্যা। এক্ষেত্রে সংক্রামিত পানি পান করে মানুষ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হন। এই ধরনের সমস্যা অনেকসময় মহামারীর আকার নেয়। শহরে অনেকসময় পানির পাইপ ফেটেও পানিতে সংক্রমণ হয়। মূলত বর্ষাকালে পানীয় পানির পাইপ লাইনে ফাটলের মাধ্যমে নোংরা পানি প্রবেশ করে। তখন পানি সংক্রামিত হয়। সেই পানি পান করেও বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক নজরে জেনে নিন, বিভিন্ন পানি বাহিত অসুখ।

ব্যাকটেরিয়াল ডায়ারিয়াঃ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে মূলত মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত হন। সাধারণত এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া অন্ত্র বা ইনটেসটাইনে ইনফেকশন তৈরি করে। ফলে মানুষ ডায়ারিয়াতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে রোগী বারংবার তরল মলত্যাগ করেন। পাশাপাশি বমি, পেট কামড়ানো, জ্বরের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এই সমস্যার প্রাথমিক চিকিৎসা হল ওআরএস। ডায়ারিয়ার সময় শরীরকে রিহাইড্রেট করার জন্য ওর‌্যাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওআরএসের কোনও জুড়ি নেই। ডায়ারিয়া শুরু হওয়ার সময় থেকেই ওআরএস মেশানো পানি পান করলে ভালো ফল দেয়। এক্ষেত্রে এক প্যাকেট ওআরএস এক লিটার পানিতে গুলে নিতে হবে। তবে সমস্যা খুব বেড়ে গিয়ে থাকলে অবশ্যই অপেক্ষা না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

অনেকের আবার পায়খানা, বমির সমস্যায় ওষুধের দোকানে বলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার অভ্যেস রয়েছে। এই অভ্যেস কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর থেকে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই ওষুধের দোকানে জিজ্ঞাসা করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার অভ্যেস ছাড়তে হবে। বদলে এমন সমস্যা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ওআরএস পান করা দরকার। সমস্যা বেগতিক বুঝলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন।

আন্ত্রিকঃ আমাশার একটি বিশেষ ধরন হল আন্ত্রিক। মূলত জলবাহিত ব্যাকটেরিয়া থেকেই এই সমস্যায় মানুষ আক্রান্ত হন। অনেকসময় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অনেক মানুষ একসঙ্গে আন্ত্রিকের করলে পড়েন। এক্ষেত্রে রোগী বারংবার রক্ত যুক্ত মলত্যাগ করেন। সঙ্গে পেটে ব্যথা থাকে। এই জটিল সমস্যা সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

জন্ডিসঃ এই সময়ে পানিবাহিত হেপাটাইটিসের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। মূলত হেপাটাইটিস ই ভাইরাসটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সমস্যার নেপথ্যে দায়ী। তবে সংখ্যায় কম হলেও, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস পানিবাহিত হয়ে মানুষের শরীরে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

সাধারণত, সেপ্টেম্বর মাস নাগাদই জলবাহিত হেপাটাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। কারণ এই ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করার পর প্রায় চার থেকে ছয় সপ্তাহ বাদেই রোগ লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এই সময়টি হল পানিবাহিত হেপাটাইটিসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড। এক্ষেত্রে রোগীর গা-হাত-পা ম্যাজ ম্যাজ করে, চোখ হলদে হয়ে যায়, গা বমি ভাব দেখা দেয়। এছাড়া শরীরে আরও কিছু লক্ষণ ফুটে উঠতে পারে। হেপাটাইটিসের মতো অসুখে প্রথম থেকেই সঠিক চিকিৎসা দরকার। তাই রোগীর শরীরে এমন লক্ষণ দেখা দিলে, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

টাইফয়েডঃ পানিবাহিত অসুখের তালিকায় টাইফয়েডের নামটি বিশেষভাগে উল্লেখযোগ্য। সামলোনেল্লা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। মূল রোগ লক্ষণ হল জ্বর। এক্ষেত্রে জ্বরের মাত্রা থাকে বেশি। পাশাপাশি দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, বারবার মলত্যাগের মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে। এই রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু যত শীঘ্র সম্ভব রোগ নির্ণয়ের। তাই টাইফয়েডের লক্ষণ দেখা দিলেই অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

অনেকসময় রোগীর টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস একসঙ্গে হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে রোগীকে টাইফয়েডের লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আনা হয়। পরে হেপাটাইটিস ধরা পড়ে। তবে এক্ষেত্রেও তেমন দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চললে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে

১. পানিবাহিত রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হল পরিশুদ্ধ পানি পান করা।

২. গ্রামের দিকে যেই পুকুর বা জলাশয়ের জলপান করা হয়, সেই পানিতে গোসল , কাপড় কাচা বন্ধ করতে হবে।

৩. সবথেকে ভালো হয় বর্ষার সময় টিউবওয়েলের পানি পান করতে পারলে। মোটামুটি ২০০ ফিট বা তার বেশি গভীর টিউবওয়েলের পানিতে সংক্রমণের আশঙ্কা খুব কম। আর অপরদিকে শহরাঞ্চলে পরিশোধিত পানীয় পানি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।

৪. কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট পানিবাহিত অসুখের প্রকোপ বাড়লে সেখানকার মানুষ এবং প্রশাসনকে অবশ্যই আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

৫. সবথেকে ভালো হয় পানি ফুটিয়ে পান করলে। তবে সব সময় পানি ফুটিয়ে পান করা সম্ভব নয়। বিশেষত আমাদের মতো দেশে সকল মানুষ জ্বালানি পুড়িয়ে পানি ফুটিয়ে পান করবেন, এটা ভাবাই অবাস্তব। তাই গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সরকারকেই মানুষের কাছে পরিশোধিত পানীয় পানি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...