পাবনার শুরু হয়েছে ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা

paban_ouja_PBA-02

পিবিএ,পাবনা: পাবনার চাটমোহর উপজেলার বড়াল নদীর পাড়ে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বোঁথড় গ্রামে শনিবার শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা। তিন দিনব্যাপী এ মেলা আগামী সোমবার শেষ হবে। প্রায় সাতশ’ বছরের ঐতিহ্যের এ মেলাকে ঘিরে জনসাধারণ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সময়ের পরিক্রমায় মেলার জৌলুস আগের চেয়ে কমে গেছে বলে প্রবীণজনরা জানান।

শনিবার পাট ঠাকুরের পাটে ধুপ দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় চড়ক পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এরপর চড়ক গাছ দিঘীর পানি থেকে তোলার পর মনোবাসনা পূরণের আশায় গাছে তেল, দুধ, চিনি, মাখন ঢালেন ভক্ত অনুসারীরা। এছাড়া আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ছিল ভরন চালান, কালী নাচ, পাঠাবলি, ফুল ভাঙ্গা, হাজরা ছাড়া সহ আনুসাঙ্গিক পূজা অর্চনা। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে হাজারো পূণ্যার্থী চড়ক গাছে দুধ চিনি ঢালছেন। পূজা ও মেলাকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু এপার বাংলা নয়, ওপার বাংলা থেকে এসেছেন পুণ্যার্থীরা। মেলা প্রাঙ্গনে বসেছে নাগরদোলা। নানা ধরেেণর পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা। শুধু এপার বাংলা নয়, ওপার বাংলা থেকেও ভক্ত-পূন্যার্থীরা আসেন এই চড়ক পূজা ও মেলায়। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্নভাবে পূজা অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উদযাপন কমিটি ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে সব ধরনের ব্যবস্থা।

এদিকে শনিবার বিকেল ৫টায় বোঁথর মহাদেব মন্দির প্রাঙ্গনে নব নির্মিত শ্রী শ্রী হরিমন্দির ও নাট মন্দিরের শুভ উদ্বোধন করেন ভারতীয় দূতাবাসের (রাজশাহী) সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জিব কুমার ভাট্টি। মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি বিরেন্দ্র নাথ দাসের সভাপতিত্বে ধর্মীয় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. মকবুল হোসেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, পাবনা জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন, নব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ মাস্টার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকার অসীম কুমার, পৌর মেয়র মির্জা রেজাউল করিম দুলাল, সহকারী পুলিশ সুপার ফজল-ই খুদা পলাশ, প্রেসক্লাবের সভাপতি রকিবুর রহমান টুকুন প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিংকর কুমার সাহা।

pabna_hindu-puja-PBA

এক সময়ের ক্ষুরধার এখন মৃত বড়ালের পাশের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বোঁথড়। এ গ্রামটির বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় উপমহাদেশের বিখ্যাত চড়কমেলা বসে। শেষ চৈত্রের গোধুলিলগ্নে চড়ক গাছ মাটিতে পুঁতে ঘোরানো হয়। প্রায় ১৩ হাত দৈর্ঘের শাল গাছটি চড়ক গাছ নামে পরিচিত। তেল মর্দন করতে করতে গাছটি কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেছে। চড়ক গাছটির গায়ে রয়েছে গরুর ক্ষুরের ও কোচের চিহ্ন।

চড়কমেলা সম্বন্ধে বোঁথড় গ্রামের বাসিন্দা এবং এ পূজার প্রধান পুরোহিত সৌরেশ চক্রবর্তী শুটকা ঠাকুর বলেন, বান রাজার আমল থেকে অর্থাৎ প্রায় ৭০০ বছর আগে থেকে এখানে চড়কমেলা চলছে। প্রথম চড়কগাছ প্রতিস্থাপন করেছিলেন মাখন স্যানাল নামের এক কাঠ ব্যবসায়ী। আসাম থেকে কিনে আনা তার কাঠের মধ্যে চড়কগাছের আগমন ঘটেছিল এখানে। আর মাখনের স্ত্রীকে স্বপ্নের মাধ্যমে দেবতা মহাদেব জানিয়ে দেন চড়ক হয়ে তিনি এসেছেন এখানে। তাকে স্থাপন করে যেন পূজা দেওয়া হয়। সেই থেকে স্যানাল আর আচার্য্য পরিবার পূজা শুরু করেন হলদার আর সূত্রধরদের নিয়ে।

আচার্য্য পরিবারের সদস্য বিপ্লব কুমার আচার্য্য পিবিএকে জানান, গ্রামে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই জামাই-মেয়েকে এরই মধ্যে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন। নতুন জামাই-মেয়েকে এ সময় ইলিশ মাছ খাওয়ানের চল বহুদিনের। জামাই-মেয়ের পাশাপাশি দুরের আত্নীয়-স্বজনওরাও বোথর গ্রামে বেড়াতে এসেছেন। তিনি আরও জানান, এবারের ৩ দিনের উৎসবের মধ্যে শনিবার(১৩ এপ্রিল) চড়কগাছ পুকুরের পানি থেকে তোলা হয়। ভক্ত অনুসারীরা তাদের মনবাসনা পূরনের আশায় চড়ক গাছে তেল দুধ-দই-চিনি মাখে। ভরন চালান দেওয়া, ভরন নাচ, কালীনাচ, পাঠাবলিসহ আনুসাঙ্গিক পূজা-অর্চনা হয়েছে। রাতে ফুলভাঙ্গা, হাজরা ছাড়া হচ্ছে। রোববার চৈত্র সংক্রান্তির তিথিতে চড়কগাছ ঘোরানো হবে। রোববারের দিনটাই বেশী জাকজমকপূর্ন হবে এবং লোক সমাগমও বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। সোমবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বোঁথড়ের চড়ক পূজা ও মেলা উৎসব শেষ হবে।

এদিকে চড়ক পূজা প্রথম যে বাড়ি থেকে শুরু হয়, সেই ‘চাঁদবাড়ী’র বড়কর্তা শংকর কুমার সাহা পিবিএকে জানান, মেলার জৌলুস আগের চেয়ে কমে গেছে। তিনি বলেন চড়কবাড়ির মন্দির টিনের আটচালা থেকে এখন পাকা হয়েছে বটে তবে সেই জৌলুস নেই। আগে টানা সাত দিন চলত মেলা। এখন পরিধি কমে ৩ দিনে এসে ঠেকেছে। মেলার লোক সমাগমের গমগম শব্দ আগে ৫ কি.মি দূর থেকেও কানে বাজত। তিনি আরও জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, ঢাকা এমনকি ভারত থেকে রকমারী পন্যসামগ্রী নিয়ে দোকানদাররা আসত মেলায়। নাগরদোলা, ঘোড়াদোলা, বায়োস্কোপ, যাত্রা, পুতুলনাচ, সার্কাস আসতো। বলেন, ভারতের বিখ্যাত ‘জেমিনি সার্কাস’ আসতো। এখন অনেক কিছুই শুধু স্মৃতি বলে তিনি জানান।

বোঁথড় চড়কপূজা পরিচালনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক অশোক চক্রবর্তী ও সম্পাদক কিংকর সাহা জানান, প্রতিবারের মতো এবারও শান্তিপূর্ন ভাবে চড়কমেলা হবে বলে তারা আশাবাদী।

পিবিএ/এফএস

আরও পড়ুন...