খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলনে প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ

“পাহাড়ে অস্থিতিশীল সাম্প্রতিক ঘটনা ছিলো পরিকল্পিত”

আল-মামুন,খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: সাম্প্রতিক হামলা,লুটপাট,অগ্নিসংযোগ,ভাংচুর ও হত্যাকা-ের ঘটনা পরিকল্পিত দাবী করে খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেছে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন। পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব ঘটনার প্রতিবাদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আমাদের প্লাটফর্ম সম্পর্কে স্পষ্টকরণের জন্য সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল ১০টায় খাগড়াছড়ি হিল ফ্লেভারস রেস্টুরেন্টে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন এর শিক্ষার্থী তুষিতা চাকমা। এতে অংশ নেন, সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন এর ছাত্র প্রতিনিধি, কৃপায়ন ত্রিপুরা,কিকো দেওয়ান,লাব্রেচাই মারমা,পরান ধন চাকমা।

এতে আবু সাইদ, মুগ্ধসহ সেই সকল বীর শহীদদের, যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে জীবন দিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের কবল থেকে জনগণকে মুক্তি দিয়েছে বলে মন্তব্য করে সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক হামলা এবং গুলিতে নিহত চার শহীদ জুনান চাকমা ,রুবেল ত্রিপুরা,ধনরঞ্জন চাকমা ও অনিক চাকমাকে স্মরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল প্রমাণ করে পরিকল্পিতভাবে মব জাস্টিস ও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ সংবাদ সম্মেলনকারীরা।

এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানানো হয়। তারা লিখিত বক্তব্যে আরো জানান,দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের সবচেয়ে ভয়ালরূপ প্রত্যক্ষ করেছে পাহাড়বাসী। রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুর নিপীড়ন-নির্যাতন,ভূমিদখল, খুন, গুম, হত্যায় অতিষ্ঠ ছিল পাহাড়ি জনজীবন; ছিলনা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাও। পাহাড়ি জনগণও জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পার্বত্য জেলাগুলোতে পালিত হয়েছিল মিছিল-সমাবেশ, অবরোধসহ নানান কর্মসূচী।

ফ্যাসিবাদীদে গুলিতে যখন একের পর এক ছাত্রজনতা আহত-নিহত হচ্ছিল, প্রতিবাদে ঢাকা-চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সমতলবাসীর সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরাও রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন পাহাড়িদের বহুদিনের। স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে গণপরিষদে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্নের কথা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন। পাহাড়ি জনগণের স্বতন্ত্রতা রক্ষার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলেছিল দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছরেও ক্ষমতাসীন সরকারগুলো চুক্তির মৌলিক ধারাগুলি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা দেখায়নি। যার ফলে পাহাড়ের সংকটসমূহ আরো প্রকট রূপ ধারণ করেছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ”জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায়” উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছিলাম এই “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” প্লাটফর্ম।শুরু থেকেই সংবিধান সংস্কারে পাহাড়ি আদিবাসীদের মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সংবিধান সংস্কার কমিশনে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের থাকার কথা থাকলেও আমরা জেনেছি একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চাপে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। যা বৈষম্যহীন ইনক্লুসিভ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের পর থেকে রাষ্ট্রের কোনো শাসকই আমাদের রাষ্ট্র গঠনে সম্পৃক্ত তো করেনি বরং সবসময়ই পার্বত্য চট্টগ্রামকে তারা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পাহাড়ে কৃত্রিম ও পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে দীঘিনালা, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সংগঠিত করা হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৪ টা’র দিকে মো: মামুন নামে এক চোর খাগড়াছড়ি সদরে নিউজিল্যান্ড এলাকায় মোটরসাইকেল চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে। পরে পালাতে গিয়ে উত্তেজিত জনতা চোর মো: মামুনকে ধাওয়া করলে বৈদ্যুতিক খাম্বায় ধাক্কা খেয়ে গুরুতর আহত হয়। চোর মামুনকে হসপিটালে নেওয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।

এই ঘটনার দায়ভার পরিকল্পিতভাবে চাপিয়ে দিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালায় সেটলারদের আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল থেকে উস্কানিমূলক স্লোগান দিয়ে, গুজব ছড়িয়ে পাহাড়িদের উপর হামলা করে দোকানপাট-ঘরবাড়িতে লুটপাট-ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দীঘিনালা ঘটনার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরের নারানখাইয়া ও জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসলে ব্রাশফায়ারে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন এবং আহত হয় ২০ জনের অধিক।

দীঘিনালায় সাম্প্রদায়িক হামলা এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারে হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটিতে “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন”—এর উদ্যোগে আয়োজিত মিছিলে মসজিদের মাইক থেকে মসজিদে হামলা হয়েছে গুজব রটিয়ে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উপর সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয় শহীদ অনিক চাকমাকে।

গত ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া এক পাহাড়ি নাবালিকা ছাত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে আবাসিক ভবনে নিয়ে গিয়ে তার রুমে আটকিয়ে রাখে। বিষয়টি জানাজানি হলে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে মেয়েটিকে উদ্ধারে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে যায়।

মেয়েটিকে উদ্ধারের পর সে শিক্ষক সোহেল রানা কর্তৃক ধর্ষণের স্বীকারোক্তি দিলে এক পর্যায়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয় ও নিরব ভূমিকায় পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ধর্ষক সোহেল রানাকে গণপিটুনি দেয় বলে জানানো হয় বক্তব্যে। পরে মহাজন পাড়া ও সুইস গেট এলাকায় পাহাড়িদের দোকানপাট-ঘরে লুটপাট, ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। এ সময় অভিযোগ তোলা হয় পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-গুলোকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার ভিক্টিম পাহাড়িরা। এসব ঘটনায় বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে, উল্টো আক্রমণের শিকার পাহাড়িদের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়েছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগযুগ ধরে চলে আসা পাহাড়িদের উপর রাষ্ট্রের ধারাবাহিক বিমাতাসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে জানানো হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্ম জনগণের সম্মিলিত শক্তিসহ সারা দেশের অধিকার সচেতন প্রগতিশীল মানুষের ঐক্যবদ্ধতা, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে পাহাড়ের অভিভাবকতূল্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণকারীদের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে পাহাড়ের সংকট-সমস্যা সমাধান করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও স্ব -স্ব জাতিসত্তার স্বীকৃতিসহ ৮ দফা দাবী জানানো হয়।

আরও পড়ুন...