পিবিএ ডেস্ক: ঢা কার রিকশায় সওয়ারি হয়ে যখন পুরানা পল্টনের মোড়ে নামলাম, তখন জানুয়ারির সকাল তেড়েফুঁড়ে ছুটেছে দুপুরের দিকে। আমাকে নামিয়ে দিয়েও রিকশাওয়ালার সন্দেহ যায় না, ‘আপনে এইখানেই নামবেন? দেখার তো কিছু নাই এইখানে। রাস্তাঘাট, অফিস আর হোটেল। কলকাতা থিক্যা এই দ্যাখতে আসছেন? রমনা না, বসুন্ধরা মল না, পুরানা পল্টন?’
কথা সত্যি। যে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, তা ঢাকা না হয়ে কলকাতাও হতে পারত। আমাদের এক্সাইড মোড় থেকে চৌরঙ্গি রোড ধরে যেমন নাক বরাবর হাজির হওয়া যায় ধর্মতলার মোড়ে, ঠিক তেমনই, মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে রাজপথ সোজা এগিয়ে গিয়েছে ‘দৈনিক বাংলা’ মোড়ের দিকে। তার পর, বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ ‘বায়তুল মোকাররম’ আর লাগোয়া মার্কেট-বাজারকে বাঁ হাতে রেখে, দেখতে দেখতে পুরানা পল্টন মোড়। মহানাগরিক চরিত্র মোটের ওপর একই, সেই উদ্ধত নির্লিপ্ত অফিসপাড়া— বড়-মেজো-সেজো বহুতল, বিমা অফিস, দেশি-বিদেশি ব্যাংক। রাস্তায় বাস-অটো-গাড়ির অনন্তধারা। দুর্বিনীত বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাওয়া রিকশার স্রোত দেখে শুধু বোঝা যায়, শহরটা কলকাতা নয়, ঢাকা। একুশ শতকের এই শহরে পুরানা পল্টনও হয়ে উঠেছে নতুন। এর মধ্যে কি খুঁজে পাওয়া যাবে পুরনো ‘পুরানা’-কে? খোঁজ মিলবে ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের, ঢাকা যাঁর তারুণ্যের শহর, আর কলকাতা যৌবন ও যৌবনোত্তর কালের, সেই বুদ্ধদেব বসুর ঠিকানা?
দেড়শো-দুশো বছর আগে এইখানটাই খাঁ-খাঁ ময়দান ছিল? এখানেই ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ক্যান্টনমেন্ট? শহর বদলে যায়, নামগুলো থেকে যায় ইতিহাসের মরচে নিয়ে। ইংরিজি শব্দ ‘প্লাটুন’ থেকে বাংলায় গড়িয়ে আসা ‘পল্টন’ সেই প্রাচীনেরই সাক্ষী। পুরানা পল্টন, মানে ‘পুরনো সেনানিবাস’। সে যুগের ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস নির্দেশ দিয়েছিলেন, শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে, নবাবপুর-শাঁখারিবাজারের ও পারে গড়তে হবে নতুন এক ক্যান্টনমেন্ট— সিপাইদের ব্যারাক, অফিসারদের কোয়ার্টার্স, প্যারেড গ্রাউন্ড। সেটা ১৮২০-র দশক। পল্টন তখন বিশাল অজ ময়দান এক। পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। মশা পিনপিন করছে, ম্যালেরিয়ার আঁতুড়ঘর। সাহেব অফিসাররা থাকতে চায় না। ১৮৪০-এর দশকে এক কর্নেলের লেখায় পাওয়া যায়, এখানে চাকরির ট্রান্সফার মানে আসলে শাস্তি। সে কালের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ঢাকা নিউজ’ খবর করেছিল, ১৮৫২-র দ্বিতীয় বর্মি যুদ্ধে সাগর পাড়ি দিতে না-চাওয়া এক সিপাইকে নাকি পল্টনে থাকার ‘পানিশমেন্ট’ দেওয়া হয়েছিল। কিছু বছর না যেতেই ক্যান্টনমেন্ট ফের ফিরে গেল লালবাগে।
সেনা থেকে হোমরাচোমরা অফিসার, কারও সার্টিফিকেট না-পাওয়া পল্টন হাতবদল হয়ে গেল পুরসভার কাছে। পুরসভা কমিটি পল্টনের একটা অংশে বাগান করলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে তার নাম হল ‘কোম্পানি বাগান’। বাকি জায়গায় বিশাল ময়দান, শহরের শতাব্দীপ্রাচীন ঢাকা কলেজ-এর ছেলেছোকরারা সেখানে ফুটবল পেটায়। ক্রমে সেই মস্ত মাঠটাই হয়ে দাঁড়াল বচ্ছরকার দৌড়ঝাঁপ, কুস্তি প্রতিযোগিতার জায়গা। লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা বড়লাট ভিজিটে এলে সেখানেই হত কুচকাওয়াজ বা গুলিবন্দুক ছোড়ার দমদমা। আর উনিশ শতকের শেষাশেষি মাঝে মাঝে হতে থাকল জনসভা, অনেক লোক ধরে বলে এখানেই সুবিধে।
১৮২০-র দশকে যে পল্টনে ব্যারাক গড়ছেন চার্লস ডস, একশো বছর পর ১৯২০-র দশকের সেই পুরানা পল্টনেই দিদিমার তোলা টিনের বাড়িতে এসে এসে উঠছেন বুদ্ধদেব বসু। কুমিল্লার জন্মস্থান, নোয়াখালির শৈশব পেরিয়ে ঢাকায় এসেই নয় ক্লাসে ভর্তি হওয়া তাঁর, ম্যাট্রিক দেওয়া। ওয়াড়ির র্যাংকিন স্ট্রিট, আর্মানিটোলা, লালবাগের সাময়িক বাস শেষে যখন পুরানা পল্টনে আসছেন, ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন। জানুয়ারির সেই দুপুরে, পুরানা পল্টনের চারমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে মনে আসছিল বুদ্ধদেবের লেখা পুরানা পল্টনের ছবি। অনেকেই সে এলাকাটাকে তখন ডাকেন ‘সেগুনবাগান’ বলে (ঢাকা শহরে, পুরানা পল্টনের কাছেই সেই পাড়া— সেগুনবাগিচা— এখনও আছে)। রমনার পূর্ব সীমান্তে, সত্যিই সেখানে এক কালে ছিল সেগুনের মস্ত বড় বন— বুদ্ধদেবের স্বচক্ষে দেখা। সেই বন কেটে পরে জমি বার করা হল, বাঙালি বাবুরা বাড়ি করে থাকবেন। বুদ্ধদেবের দাদু একখানা প্লট বায়না দিয়ে রেখেছিলেন, জীবদ্দশায় নিজে ঘর তুলে যেতে পারেননি। সেই ঘর তুললেন বিধবা দিদিমা। পদ্মার জলে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের বাড়ির অবশিষ্ট কিছু করোগেটেড টিন তিনি পেয়েছিলেন স্বামীর উত্তরাধিকারে, সেইগুলো দিয়েই টিনের ঘর খাড়া করলেন পুরানা পল্টনে। গোটা পুরানা পল্টনে, এবড়োখেবড়ো মাঠের মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো তিনটে মোটে বাড়ি তখন, তারই একটা ওঁদের। তিন কামরার ঘরের প্রথমটাতেই থাকেন বুদ্ধদেব। বর্ষাকালে মাটির মেঝে ফুঁড়ে কেঁচো বেরোয়, তাই দিদিমা ওঁর ঘরটুকু শুধু সিমেন্টের মেঝে করে দিলেন। মাঘ-রাতে সেই ঘরই হয়ে ওঠে বরফের বাক্স, তাই দেওয়ালে এঁটে-সেঁটে দিলেন খবরকাগজ।
২০১৭-র পুরানা পল্টনে দাঁড়িয়ে একশো বছর পুরনো মাঠ-মাটির ঘ্রাণ আর নাকে আসে না। বুদ্ধদেব দেখেছিলেন তাঁর ঘর থেকে পুবে-উত্তরে শুধু বনজঙ্গল আর তাঁর অনন্য গদ্যে ‘অনির্ণেয় গ্রাম’, দক্ষিণে রেললাইন পেরিয়ে নবাবপুরের বসতি, আর একুশ শতকীয় ঢাকায় মামুনের চায়ের দোকানে আদাকুচি-লবঙ্গ-এলাচ শোভিত লাল চা (এখানে বলে রং চা) খেতে খেতে আমি দেখি নগরসভ্যতার ক্রমবিয়োজন। ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের ঘরের বাইরে তুলসীমঞ্চ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে থাকা অপরাজিতা আর শরতে স্থলপদ্ম ছিল, ঘাসের সবুজে জ্বলজ্বল করত লাল কেন্নো, চৈত্রের বাতাস উড়িয়ে নিত কবির কাগজপত্র, নিভিয়ে দিত সন্ধের কেরোসিন-ল্যাম্প। সারা দুপুর শোনা যেত ছাদ-পেটানোর গান— সারেঙ্গির বাজনা আর মুগুরের তালের সঙ্গতে গান গেয়ে চলা জন কুড়ি-পঁচিশ মুগুর পেটানো বাচ্চা ছেলে। আর এখন, আমি কলকাতা থেকে এসেছি শুনে পুরানা পল্টন মার্কেটে এলইডি লাইট আর ল্যাম্পশেডের দোকানের কর্মী চঞ্চল গলা নামিয়ে বলে, ‘দাদা, এই ঢাকা কি আর সেই ঢাকা, না মানুষগুলা এক? অহন ওই সব লোকরে কেউ জানেই না এইখানে।’
পুরানা পল্টনের এই ঠিকানা থেকেই বেরোত বুদ্ধদেবের ‘প্রগতি’ পত্রিকা। বরিশাল থেকে ডাকে কবিতা পাঠাতেন জীবনানন্দ দাশ। গান পাঠাতেন কাজী নজরুল ইসলাম। অদূরে ইসলামপুর থেকে আসতেন বুদ্ধদেবের প্রিয় বন্ধু টুনু— জগন্নাথ কলেজের ছাত্র অজিত দত্ত। একসঙ্গে তুর্গেনেভ, রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ বা পলগ্রেভ সাহেবের বই থেকে শেলি-কিট্স-ব্রাউনিং পড়া, কলকাতা থেকে ডাকে আসা সাহিত্যপত্রিকা গোগ্রাসে গেলা। পোস্টাপিসের পিন নম্বরের জোরে গুঁতিয়ে কলকাতার ম্যাপে ঢুকে পড়া শহরতলির লোকজন এখনও যেমন অনভ্যাসে বলে ফেলেন ‘এই একটু কলকাতা যাচ্ছি’, সেই রকমই, তখন পুরানা পল্টনের বাড়ি ফেরা মানে ‘শহর থেকে ফেরা।’ পিছনে পড়ে থাকত ঢাকা শহরের আলো, আর্মানিটোলার পিকচার-হাউস, নবাবপুরের রেলক্রসিং। আজকের ঢাকায় সেই ছবিঘর নিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম, ‘লোকে বসুন্ধরায় (মাল্টিপ্লেক্স) যায়।’ নবাবপুর পরে গিয়েছি, সে যেন অবিকল আমাদের চাঁদনি চক আর বড়বাজারের কার্বন কপি, কিন্তু সেই রেললাইন কই? একশো বছর আগের পুরানা পল্টনে, বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, ‘বাতাস অনেক বেশি স্বাদু, রাত্রি অনেক বেশি গভীর।’ আজকের ঢাকার বর্ণ-গন্ধ-স্বাদের মানচিত্র বদলে গিয়েছে, আমার বাংলাদেশি বন্ধুরা আমাকে নিয়ে যেতে চান হাতির ঝিল-গুলশানের তিলোত্তমা ঢাকায়, কলকাতার অনেকাংশের মতোই যেখানে ইতিহাস চাপা পড়ে আছে নতুনের বৈভব-ঔদ্ধত্যে।
যদি কখনও কোনও দুর্বিপাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ডাবলিন শহরটা ধুয়েমুছে যায়, আমার লেখা থেকে আপনি তাকে ফের অবিকল তুলে আনতে পারবেন— জেমস জয়েস লিখেছিলেন তাঁর প্রকাশককে। এক-এক জন লেখকের কলমে এ ভাবেই তো ধরা থাকে এক-একটা শহর আর পাড়ার ইতিহাস-ভূগোল, আত্মা। সে দিন বাসে চড়ে ফেরার সময় মনে হচ্ছিল, এই নতুন পুরানা পল্টনের নীচেই তো ঘুমিয়ে সেদিনকার পুরানা পল্টন। ঢাকা, কলকাতা, দু’পারের বাঙালিই মনে রাখেনি, রাখে না, তাতে কী!
পিবিএ/জেআই