পিবিএ ডেস্কঃ গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১টায় হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলেন কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী তন্ময়। বাসার সামনে দাড়ানো ছিল একটি সিএনজি অটোরিকশা। গাড়ীর মধ্যে বসা পোশাকধারী ৩ পুলিশ সদস্য, গাড়ীর চালক ও আরো এক লোক। পরে বুঝলেন সাথে থাকা লোকটি পুলিশের সোর্স। সেই সোর্স কোন কিছু না বলেই তন্ময়ের পকেটে হাত ঢুকাতে চেষ্টা করে। এতে তন্ময় বাধা দেন এবং পুলিশের ওই সোর্সের হাত দেখাতে বলে। এরপর তাকে তল্লাশী করতে বলে। আর এতেই গাড়ীতে এক দারোগা ক্ষিপ্ত হন। এ সময় তন্ময়কে বেশ ধমকান ওই পুলিশ অফিসার। বেশি বাড়াবাড়ি করলে গাড়িতে তুলে নেয়ার হুমকিও দেন বলে এই প্রতিবেদক তন্ময় জানায়। পরে বাসার লোকজন হৈচৈ শুনে ঘর থেকে বের হলে পুলিশ ও কথিত সোর্স সেখান থেকে সটকে পড়েন।
হয়রানির অভিযোগ করেন নগরীর মেন্দিভাগের মাসুদ নামে আরেকজন। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে সিলেট ফিরছিলেন। তখন রাত অনুমান ২টার কাছাকাছি। হুমায়ুন রশীদ চত্বরে নেমে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। শাহজালালা ব্রিজ (নতুন ব্রিজ) উঠতেই চোখে পড়ে অন্ধকারে একটি সিএনজি অটোরিকশা দাঁড়ানো। কাছে যেতেই দেখলাম পুলিশ, সিগন্যাল দেওয়া হলো থামানোর জন্য। সাথে-সাথে ই থেমে যাই। পুলিশ সদস্যরা বললেন আমার দেহ ও ব্যাগ চেক করবেন। মাসুদ বলেন, ঠিক আছে ভাই, চেক করেন তবে একটু তাড়াতাড়ি আমি ঢাকা থেকে এসেছি খুব ক্লান্ত। চেক করে কিছুই পায়নি। তখন পুলিশ সদস্যরা রিকশা চালককে চলে যেতে বলেন। প্রায় ১ ঘণ্টার উপরে টহল গাড়িতে ঘুরিয়ে, খারাপ ভাষায় গালাগালি, আপত্তিকর নানা প্রশ্ন করতে থাকেন! এক পর্যায়ে তারা গোটাটিকর পয়েন্টে একটি চায়ের দোকানে দাঁড় করিয়ে পুলিশ সদস্যরা নেমে যায়। তখন গাড়ীর ড্রাইভার আমার কাছে বলে ভাই পাঁচ হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দিবেন। দেখেন পারেন নি দিতে বলেই গাড়ী থেকে সেও নেমে যায়। তখন আমি বলে ভাই আমার কাছে এতো টাকা নাই, বাসায় ফোন দিবো। ৩/৪ মিনিট পর ড্রাইভার আবার এসে বলে, হুদাই বাসায় ফোনটন দিয়ে লাভ কিতা। কিছু খরচাপাতি দিয়ে দেন। এতো রাত হইছে স্যাররা চা-সিগারেট খেতে হবে। আমিও নিরুপায় হয়ে মানি ব্যাগে থাকা ৭৫০ টাকা ছিলো পুরোটাই তাদের দিয়ে ফেলি। এরপর অসহায়ত্ব মনে বাসার পথে হাটা ধরি! এমন ঘটনা প্রতি রাতে নগরীর কোন না কোন এলাকায় ঘটছে। সিলেট নগরীর সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন সোর্স আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জানা যায়, এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় সোর্সের সাহায্য নিচ্ছেন।
এদের বেশির ভাগ লোকই মাদক বিক্রেতা, দূর্ধষ সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। অনেকে শত্রুতার ঝাল মেটাতে আশ্রয় নিচ্ছেন সোর্সের। অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে সোর্সরা ভুল তথ্য দিয়ে নিরীহ মানুষকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। সন্ধ্যার পর থেকে মহানগরীর থানা ও ফাঁড়িগুলোর সামনে এসে ভিড় করেন কতিপয় সোর্স। পছন্দমতো দারোগাদের সাথে রাতে সোর্স হিসাবে কাজ করতে হয় কন্ট্রাক্ট। এরপর সারারাত সোর্সরা ‘ধান্ধা’ খুঁজতে থাকেন। যতো বেশি ‘ধান্ধা’ ততো বেশি টাকাকড়ি পকেটে ঢুকছে। রাত ১২ থেকে ১টা। ওই সময় শহরের বেশির ভাগ মানুষ কর্মক্ষেত্র থেকে বাসা-বাড়িতে ফিরেন। সেই সময়টাকে উপযুক্ত টাইম হিসাবে বেছে নিয়েছে সোর্সরা।
সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন নগরীতে টহলের নামে গভীর রাতে পথচারীদের আটকে চাঁদাবাজি করাই টহল টিমের। ডিউটিতে থাকা কতিপয় দারোগারা নিরীহ মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও চাহিদা মতো অর্থ দিতে না পারলে পেন্ডিং মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। এমনকি নিজেদের কাছে থাকা ইয়াবা ও গাঁজা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উদ্ধার দেখানোর নামে আদায় করা হয় অর্থ। এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে মহানগর পুলিশের ছয়টি থানার রাতে টহল থাকা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। পুলিশের কিছু সদস্যদের পকেটে থাকা ইয়াবা মানুষের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে এবং মামলা করে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তাদেরকে হেনস্তা করা হচ্ছে। পুলিশের ফাঁদে পড়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন অনেক সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ীও শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সমাধান মিলছে না। কতিপয় পুলিশ সদস্যদের পেতে রাখা মাদকের ফাঁদে পড়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে অনেকের জীবন।
অপর একটি সূত্র জানায়, এসএমপির বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে থাকা দারোগারা স্থানীয় সোর্স ও মাদক স্পটের সাথে রয়েছে গোপন আঁতাত। এই সোর্সদের মাধ্যমে মাসে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। এছাড়া নিরীহ লোকজনদের আটক করে সোর্সদের কমিশন দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কাজকর্ম। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের আড়াল করে যারা মাদকের দ্বারে কাছেও নেই তাদেরকে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে সোর্সরা টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র মতে, ট্রাফিক বিভাগ থেকে রিক্যুইজিশন করা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নগরীতে রাতে টহল দেন পুলিশ সদস্যরা। নিজ নিজ এলাকার মোড়ের অন্ধকারে গাড়ী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। গভীর রাতে ঘরে ফেরা কোন পথচারীকে পেলেই টহল টিমের সদস্যরা তাকে আটক করে। প্রথম প্রশ্ন, এই কোথা থেকে আসছেন, এতো রাত কি ভালো লোক বাহিরে থাকে বলেই জেরা শুরু। একপর্যায়ে মিথ্যে অভিযোগে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে ঘোরাতে থাকেন। এরপর আটককৃত ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন দেখিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘সমঝোতা’ হলে রাস্তা থেকেই তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। আর দাবিকৃত টাকা পাওয়া না গেলে পেন্ডিং মামলা বা ইয়াবা-গাঁজা উদ্ধার দেখিয়ে চালান করা হয় আদালতে। যদিও বেশির ভাগই অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে একটু সচ্ছল পরিবারের কেউ হলে তো কথাই নেই। মামলা-রিমান্ডের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় হাজার হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে মেন্দিভাগ এলাকার এক পাইকারী আড়ৎ ব্যবসায়ী জানান, গত মাসের শেষ সপ্তাহে তার নিকটাত্মীয় অসুস্থ হয়ে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি বাসা থেকে রাতের খাবার নিয়ে হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে রিকশা যোগে বাসা ফিরছিলেন তখন রাত দেড়টা। সোবহানীঘাট পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি আসা মাত্র অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশা থেকে এক পুলিশ সদস্য রিকশার গতিরোধ করেন। ওই ব্যবসায়ীকে রিকশা থেকে নামার জন্য বলা হলে তিনি হাতে থাকা ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়েন। পুলিশ সদস্য বলেন, আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে আপনি মাদক ব্যবসায়ী, আপনাকে তল্লাশী করতে হবে। পুলিশের ওই কনস্টেবলের কাছে থাকা ইয়াবা ওই ব্যবসায়ীর পকেটে ঢুকিয়ে দেন। পকেট থেকে হাত বের করেই বলেন স্যার স্যার ওর কাছে ইয়াবা পাইছি। শালার বেটা সত্যিই ইয়াবা ব্যবসায়ী এমন অভিযোগ তার উপর এনে পুলিশ সদস্যরা শুরু করে হেনস্থা। এরপর আটককৃত ব্যক্তিকে নানা হুমকি-ধমকিসহ থানা নিয়ে যাবে বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তার সাথে সমঝোতা হয়। ২০ হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেবে না হলে মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দিবে। একপর্যায়ে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি ছাড়া পান। এ রকম ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই নগরের কোন না কোন এলাকায় ঘটছে।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস) মো. জেদান আল মুসা জানান, সোর্স মাধ্যমে নিরীহ লোকদের হয়রানি করে থাকলে অবশ্যই ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি নেওয়া হবে। তবে রাতে টহল পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হবে।
পিবিএ/এমআর