প্রবাসে নারী শ্রমিক নির্যাতন বাড়ছেই, পরিত্রাণ জরুরী

মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা): আমেনা বেগম মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান আর সকিনা বেগম সৌদিআরব ফেরত নারী প্রবাসী শ্রমিক। দুইজনই চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা। করোনাকালিন সময়ে নির্যাতিত হয়ে তারা দেশে ফিরেছেন। আমেনা আর সকিনার মত সারাদেশের অসংখ্য নারী শ্রমিক প্রবাসে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ তাদের সমস্যা সমাধানে নেই কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। শিগগিরই নারী শ্রমিকদের সকল সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, ভাগ্য বদলে একটু সুখের আশায় বা আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য প্রবাসে গিয়ে কাজ করেন দেশের মোট প্রবাসীর ১২ শতাংশ নারী শ্রমিক। সংখ্যায় কম হলেও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে নারী শ্রমিকরা। যে নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশের কপালে জুটছে ভয়াবহ শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার নারীরা দেশে ফিরে আসছেন এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে ফিরে এসব নারী নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছেন। গত কয়েক বছর ধরে সৌদিআরব, জর্ডান, লেবানন ও ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকরা শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, নারী কর্মীদের নির্যাতনের ঘটনা খুব কম। কিন্তু একটা মেয়েও যদি নির্যাতনের শিকার হয় তার জন্যও ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সেই ধরনের ব্যবস্থা চোখে না পড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা ১১টি সংগঠন।

সরকারি তথ্য মতে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ নারী শ্রমিক দেশের বাইরে কাজ করছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে খালি হাতে ফিরেছেন ৩১৬৪ জন নারী শ্রমিক। ২০২০ সালে ফিরেছেন ৫০ হাজারেরও বেশি। কেউ ফিরছেন অন্তঃস্বত্তা হয়ে আবার কেউ ফিরছেন সন্তান নিয়ে। এরমধ্যে ৩৫ শতাংশ নারী শারিরীক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। আর ৪৪ শতাংশ নিয়মিত বেতন না পেয়ে দেশে ফিরেছেন।

এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫ শতাধিক নারীর লাশ দেশে এসেছে। এরমধ্যে ২ শতাধিক আত্মহত্যা করেছে। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার কারো কাছে বলতে না পেরে তারা আত্মহত্যা করেছেন বলে স্বজনদের অভিযোগ। অনেকে দেশে ফিরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে দেশে ফিরে আসা ৬০ শতাংশ প্রবাসী নারী শ্রমিক বর্তমানে কর্মহীন। এছাড়া প্রতি ৩ জনে একজন নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সংস্থাটি দেশের ৩টি জেলার ১২টি উপজেলার তথ্য প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেছে। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যশোর, ফরিদপুর ও চট্টগ্রামের ৪টি করে উপজেলায় এই গবেষণা চালানো হয়।

প্রতিবেদন উথ্যাপনকালে বিলসর উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, যদিও দেশে ফিরে আসা প্রবাসী নারী শ্রমিকদের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে দেখা গেছে, প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ নারী অভিযোগ করেছেন, বিদেশে যাওয়ার পরে তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৫২ শতাংশ নারী জানিয়েছেন তাদের কাজে বাধ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু নারী শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার পরে কারাভোগ করেছেন।

নির্যাতিত সকিনা বেগম বলেন, ২০১৮ সালে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যাই। সেখানে সারাক্ষণ কাজ করতে হতো। সময় মতো খাবার দিতো না। ঘুমানোর সময়ই পেতাম না। বেশি কাজ করলেও নিয়মিত বেতন দিতো না। ফলে ৩ মাস পরই দেশে ফেরত আসি। কয়েকমাস পর ২০১৯ সালে আবারও সৌদিআরবে অন্য কফিলের কাছে যাই। ওই কফিলের পরিবারও আমাকে নির্যাতন করতো। এরপর স্বজনদের চেষ্টায় দেশে ফেরত আসি। খবর পেয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের উদ্যোগে আমাকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং আর্থিক সহযোগিতা করে। বর্তমানে বাড়ির পাশে একটি দোকান দিয়ে ভালো আছি’।

সাকিনার মত নির্যাতিত সারাদেশে অসংখ্য নারী শ্রমিকদের দেশে ফেরার পর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে ব্র্যাক অভিবাসন প্রোগ্রাম ও অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম(ওকাপ) সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।

গালফ্ নিউজের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, সৌদি আরবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের শাস্তি কঠোর করা হয়েছে। নারী নির্যাতন ও সহিংসতা প্রমাণিত হলে মোটা অঙ্কের জরিমানা ও এক বছরের জেলের ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব। সাম্প্রতিকালে মিডিয়ায় সৌদিআরবে আবিরণ বেগম হত্যার ঘটনা ব্যাপক প্রচার হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোনদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ জোগাতে ২০১৭ সালে বৈধ পথে সৌদিআরবে গিয়েছিলেন খুলনার আবিরণ বেগম। দুই বছর তিন মাস পর ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর আবিরণ লাশ হয়ে দেশে ফিরেন। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবের রিয়াদের আদালতে আবিরন বেগম হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক শুনানি শুরু হয়েছে। আদালত হত্যা মামলায় আটক সৌদি নাগরিক আবিরনের গৃহকর্তা বাসেম সালেম, তাঁর স্ত্রী আয়েশা আল জিজানি এবং ছেলে ওয়ালিদ বাসেম সালেমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। আবিরনের পরিবার লাশ পরিবহন, সৎকারসহ সরকারের কাছ থেকে মোট ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে আবিরণ বৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার কারণে। আবিরণের মতো হাজারো নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার ও মৃত্যু করলেও অবৈধ পথে যাওয়া শ্রমিকদের পরিবার বিচার ও কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ পায় না। সুতরাং-পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের জন্য দক্ষ হয়ে বৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়া আবিরণ একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।

কুমিল্লা জেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি রাশেদা আখতার বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগে যথাযথ তথ্য ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না। যে কারণে তাদের প্রত্যাশা ও নিয়োগদাতা দেশ থেকে পাওয়া সুবিধার মধ্যে সমন্বয় হয় না। আমাদের উচিত-নারী শ্রমিকদের নির্যাতন রোধে বৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়া এবং নির্যাতনের অভিযোগ পেয়ে দূতাবাস কর্তৃক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। তাহলে প্রবাসে নারী শ্রমিক নির্যাতন অনেকাংশে কমে যাবে’।

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র-এর নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, ‘বিদেশে নারী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন রোধে মনিটরিং টিম তৈরি ও সেইপ হাউজ করতে হবে। নারী শ্রমিকদের দেখভাল করার জন্য দেশের জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এছাড়াও শ্রমিকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। নারী শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন হিসেবে গড়ে তুললেই নির্যাতন কমবে’।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) চেয়ারম্যান সাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের প্রবাসে যাওয়ার ব্যাপারে জেনে-বুঝে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দালালদের মিথ্যা প্রলোভন রোধে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নারী প্রবাসে যাওয়ার সাথে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিসহ সব সেক্টরকে জবাবদিহীতায় আনতে হবে। সরকারের উচিত সৌদি সরকারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা করে নারী নির্যাতন রোধে পদক্ষেপ নেয়া। বাংলাদেশ সরকারের কঠোর পদক্ষেপ ও নারী শ্রমিকদের সচেতন করে তুলতে পারলেই নির্যাতন রোধ করা সম্ভব’।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের হেড শরীফুল হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের দালালরা নারীদের ভাগ্য বদলের প্রলোভন দেখিয়ে মিথ্যা পরিচয় ও বয়স বাড়িয়ে প্রবাসে পাঠায়। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত-প্রবাসে যাচ্ছে এমন নারীর সব প্রক্রিয়া সঠিক কিনা যাচাই করা। প্রবাসে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে সম্পর্ক রাখা। নারী কর্মীদের একত্রে থাকার ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রবাসে যাওয়া এবং আসার পুরো প্রক্রিয়া ও রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃক বৈধ উপায়ে পাঠানোর পর নিয়মিত খোঁজ রাখা। এতে করে প্রবাসে নারী শ্রমিক নির্যাতন কমে যাবে। প্রবাস সংক্রান্ত যে কোন খবর জানতে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির টোল ফ্রি ০০৮০০০১০২০৩০ নাম্বারে কল করার অনুরোধ জানান তিনি’।

আরও পড়ুন...