দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপ বিশ্বের ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে যেন এক স্বর্গরাজ্য। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এখানে আসেন প্রকৃতির স্বাদ নিতে। কোরিয়ানদের কাছ থেকে জেজু দ্বীপের অনেক গল্প শুনেছি। তাদের ভালো লাগার স্মৃতিচারণা শুনে মুগ্ধ হতাম। সেখানে যাওয়ার আগ্রহটা যেন কয়েক গুণ বেড়ে যেত। অনেক দিন আগে থেকেই জেজু যাওয়ার কথা চিন্তা করছিলাম। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে আমার এত দিন জেজু যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
কোরিয়াতে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে টানা পাঁচ দিন ছিল ছুসক, যা কোরিয়ার সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি। এ সময় কোরিয়ার কর্মব্যস্ত মানুষ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর একটা সুযোগ পেয়ে থাকে। আর এই ছুসকের ছুটিতে কোরিয়ানরা ভিড় জমান এই জেজু দ্বীপে। টানা পাঁচ দিন বন্ধ পেয়ে আমিও জেজু ভ্রমণ হাতছাড়া করলাম না। সে দ্বীপে জাহাজে গেলে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা সময় লাগে। আর বিমানে সময় লাগবে মাত্র এক ঘণ্টার মতো। এ সময়ে বিমানের টিকিটের বাড়তি দাম, তারপরও টিকিট পাওয়াটা যেন সোনার হরিণ।
করোনাকালের সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেলা ১১টায় হঠাৎ সিদ্ধান্ত জেজু যাওয়ার। সন্ধ্যা সাতটায় ফ্লাইট। সফরসঙ্গী চার বন্ধু। অনলাইনে হোটেল বুক করা ছিল। রাত আটটায় জেজুদো এয়ারপোর্টে নেমে সরাসরি হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে রাত একটার দিকে জেজু সিটির মনোরম পরিবেশে একটু হাঁটাহাঁটি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত এই দ্বীপ ‘জেজু আইল্যান্ড’ মানে জেজু দ্বীপ। পুরো দুনিয়ার সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে জেজু দ্বীপ জায়গা করে নিয়েছে ২০১১ সালে। কোরিয়ার সবচেয়ে বড় দ্বীপ এটি। কোরিয়ানরা উচ্চারণ করে ‘জেজু-দো’ বলে। বলা হয়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। যে পাহাড় থেকে আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত হয়ে জেজু দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল, তার নাম ‘হাল্লাসান’ পাহাড়।
আমাদের মতো অসংখ্য বাংলাদেশি প্রবাসীর টিমভিত্তিক দেখা। আশপাশে সব হোটেল যেন বাংলাদেশিদের দখলে। সবাই যেন জেজুর টানে মুগ্ধ হয়ে ছুটে এসেছেন। জেজু সিটি পুরোটাই ব্যতিক্রম, তাই অনুভূতির দিকটাও ঠিক অন্য রকম। অপেক্ষা, কখন সকাল হবে আর কোন স্পট থেকে শুরু করব ভ্রমণ। কারণ, জেজুর প্রতিটি পরতে অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দৃশ্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত এই দ্বীপ ‘জেজু আইল্যান্ড’ মানে জেজু দ্বীপ। পুরো দুনিয়ার সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে জেজু দ্বীপ জায়গা করে নিয়েছে ২০১১ সালে। রিয়ার সবচেয়ে বড় দ্বীপ এটি। কোরিয়ানরা উচ্চারণ করে ‘জেজু-দো’ বলে। বলা হয়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। যে পাহাড় থেকে আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত হয়ে জেজু দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল, তার নাম ‘হাল্লাসান’ পাহাড়। এই পাহাড়কেই জেজুর প্রাণকেন্দ্র বলা হয়।
এ দ্বীপের জন্ম ২০ লাখ বছর আগে, আগ্নেয়গিরির লাভা জমে জমে৷ মৃত সেই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এখন চেনা যায় না৷ ঘন সবুজ গাছের কোমলতায় সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত জেজু দ্বীপের চারপাশে যে জলরাশি, তা কেবল নামেই দক্ষিণ সাগর৷ দ্বীপটি আসলে প্রশান্ত মহাসাগর ভেদ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ কোরিয়ার দক্ষিণ উপকূল থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দ্বীপটি পশ্চিম থেকে পূর্বে ৭৩ কিলোমিটার এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১ হাজার ৯৫০ মিটার।
দ্বীপটি গঠিত হয়েছে ৩৬০টি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির সমন্বয়ে। পূর্বে জেজু দ্বীপকে ডাকা হতো জিজি ক্যাডা নামে, যার অর্থ আগ্নেয়গিরি। ১৯৪৮ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জেজু দ্বীপ। গাঢ় সবুজ দ্বীপ। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য৷ এই সমতল, তো এই পাহাড়ি খাড়াই-উতরাই৷ দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক বিস্ফোরণের প্রাচুর্য এই দ্বীপের আদিম নিসর্গকে অনেকটা নমনীয় করে এনেছে৷
জেজু আগে ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার নয়টি প্রদেশের একটি৷ গণভোটে রায় দিয়ে এ দ্বীপের বাসিন্দারা একে একটি বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে চালানোর সিদ্ধান্ত নেন৷ ২০০৬ সালের ১ জুলাই থেকে এটি কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করে৷
অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট বিচিত্র আকৃতির সব পাথরে একাকার পুরো দ্বীপ। জেজু একটি স্বপ্নের দ্বীপ, ৭০৫ বর্গমাইলের জেজু দ্বীপের আবহাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ভূখণ্ডের আবহাওয়া থেকে ভিন্ন। রাজধানী সিউল যখন তীব্র শীতে কাঁপছে, তখন হয়তো জেজু রৌদ্র-ঝলমল দিনে শীত উপভোগ করছে। সমুদ্র থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাস নাতিশীতোষ্ণ একটা আবহাওয়া ধরে রাখে বছরজুড়ে।
হাল্লা পর্বতে আরোহণ, সমুদ্রের তীরে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা, ঘোড়ায় চড়ে প্রকৃতির অনিন্দ্যসৌন্দর্য উপভোগ, রাজকীয় জলপ্রপাত দর্শন, শিকার করা, মাছ ধরা কিংবা শুধুই সৈকতে অলস সূর্যস্নান ছাড়াও বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে বছরের বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত সাঁতার প্রতিযোগিতা, বসন্তে চেরি উৎসব, মধ্যগ্রীষ্মে নৈশকালীন সমুদ্র উৎসব, হেমন্তে ঘোড়ার উৎসবসহ আরও অনেক অনুষ্ঠান।
ছোট্ট এই দ্বীপে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফাইভ স্টার হোটেলসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ইন্টারনেটের গতি এতটাই ভালো যে মনেই হবে না মূল ভূখণ্ড থেকে এটি বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ।
এটি লাভা দ্বারা তৈরি, এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দেবে। গুহায় ঢুকতেই মনে হলো গ্রীষ্ম থেকে বুঝি শীতের দেশে এসে পড়লাম, হিমশীতল অনুভূতি। গুহার ভেতরে চারপাশ অন্ধকার। মিটমিট করে কিছু আলো জ্বলছে শুধু পথ দেখার জন্য। খুবই ভয়ংকর একটি পরিবেশ। প্রায় ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই গুহা প্রস্থে প্রায় ৫ মিটার আর গড় উচ্চতা প্রায় ৭ দশমিক ৫ মিটার! এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিউব লাভা কেভ, ২৫ লাখ বছর আগে যা তৈরি হয়েছিল চলমান গলিত লাভার আবরণের মাধ্যমে! ১৩ কিলোমিটার লম্বা হলেও মাত্র ১ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারবেন দর্শনার্থীরা! তাই আর সামনের দিকে যেতে পারলাম না।
জেজুর ৬২টি উপদ্বীপের মধ্যে এ দ্বীপ সবচেয়ে বড়! ৬ দশমিক ১৮ বর্গকিলোমিটারের উদো দ্বীপের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ১৩২ মিটার! এখানে যেতে হলে ফেরি একমাত্র ভরসা! তবে উদো ঘুরে দেখার জন্য ভালো উপায় হচ্ছে সাইকেল। মূল দ্বীপ থেকে এর দূরত্ব যথাক্রমে ৬-৯ কিলোমিটার! সবুজ ফসলি জমি কালো পাথরের বড় বড় শিলাখণ্ড দ্বারা আবৃত এই উপদ্বীপটি কোস্টাল ভিউয়ের জন্য বেশ পরিচিত! উদো দ্বীপ খুব ছোট একটি দ্বীপ, দ্বীপটির মাটি উর্বর, জেজু থেকে ফেরি দিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। আগ্নেয়গিরির প্রাকৃতিক দৃশ্য, পরিষ্কার সমুদ্রের জল, বাতাসে শৈবালের গন্ধ। মুগ্ধতার জালে বন্দী হয়ে গেলাম। সেখানে পছন্দের যেকোনো বাহন নিয়ে দ্বীপটির চারপাশে ঘোরার মজাই আলাদা। আর আমাদের পছন্দের বাহন ছিল সাইকেল।
সাগরের গাঘেঁষা পাহাড় থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে একদম সাগরে। অন্য সব ঝরনা থেকে একদম আলাদা। অসম্ভব মনোরম দৃশ্য। পর্যটকদের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয় এই জিওংবং ঝরনাটি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতেই শোনা যায় ঝরনার শব্দ। সেখানে দেখলাম সাগরের কোল ঘেঁষে বেশ কিছু বয়স্ক মহিলা ছোট ছোট তাঁবুতে সামুদ্রিক মাছের দোকান নিয়ে বসেছেন। এক পাশে এত বড় ঝরনা আরেক পাশে সাগর—এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে অনেক পর্যটক এখানে বসেই সামুদ্রিক মাছ খাওয়াটা উপভোগ করেন।
এই জলপ্রপাত আমাদের সবার খুব বেশি ভালো লেগেছে। তবে এই স্থানের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে এর প্রাকৃতিক পরিবেশ। সাগরের সঙ্গে হওয়াতে ঝরনাটার আশপাশে ছোট-বড় প্রচুর কালো পাথর দিয়ে ঘেরা। চোখ যত দূর যায়—সাগরের নীল পানি।
জেজুর কমলা খুব বিখ্যাত। রাস্তার দুই পাশে কমলাগাছের সারি। কমলা পেকে নিচে পড়ে পড়ে স্তূপ হয়ে আছে। তুলে নিয়ে খাওয়ার মতো সাহস কারও নেই।
এখানে শোভা পাচ্ছে জেজুর বিখ্যাত পাথরের মূর্তি। ইংরেজিতে বললে ‘স্টোন গ্র্যান্ডফাদার’। মানুষের প্রতিকৃতিতে কালো অগ্নিকুণ্ড পাথরের করা এই মূর্তি। এই মূর্তিটা আসলে জেজুর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এই পাথরের মূর্তিরও মানে আছে। কোরিয়ানদের ধারণা, যদি কোনো গর্ভবতী নারী এই স্টোন গ্র্যান্ডফাদারের নাকে স্পর্শ করেন, তাহলে তাঁর ছেলে হবে। আর যদি কানে স্পর্শ করেন, তাহলে তাঁর মেয়ে হবে। এ ছাড়া যদি পেটে স্পর্শ করেন, তাহলে নাকি তাঁর অনেক উন্নতি হয়। এই বিশ্বাস করে কোরিয়ানরা এখনো অনেক আশা নিয়ে মূর্তি স্পর্শ করেন।
কোরিয়ানদের ধারণা, যদি কোনো গর্ভবতী নারী স্টোন গ্র্যান্ডফাদারের নাকে স্পর্শ করেন, তাহলে তাঁর ছেলে হবে। আর যদি কানে স্পর্শ করেন, তাহলে তাঁর মেয়ে হবে। এ ছাড়া যদি পেটে স্পর্শ করেন, তাহলে নাকি তাঁর অনেক উন্নতি হয়। এই বিশ্বাস করে কোরিয়ানরা এখনো অনেক আশা নিয়ে মূর্তি স্পর্শ করেন।
কোরিয়াতে সবার মধ্যে এখনো করোনা-আতঙ্ক। ছুটি কাটাতে বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা মনোমুগ্ধকর এসব পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে গেলেও তাঁরা স্বাস্থ্যবিধিকে অনেক গুরুত্বসহ মানছেন। মাস্ক না পরলে বড় অঙ্কের জরিমানারও বিধান জারি আছে সরকারের পক্ষ থেকে। ভাইরাস সংক্রমণ না কমলেও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষের আনাগোনা দিন দিনই বাড়ছে। তাই ছুসকের এই বন্ধে কোরিয়াতে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে কোরিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার (কেসিডিসি)।
জেজুর প্রতিটি মুহূর্তকে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। ফিরে আসতে ইচ্ছা করছিল না। জেজুর প্রেমে পড়ে গিয়েছি। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে, জেজু।