ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থী চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা রেখে প্রাণনাশের ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়িতে চলে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ১৭ আগস্ট ওই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের পর দুই ছাত্রলীগ নেতা তার ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন এমন অভিযোগ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে একটি চিঠি পাঠান ওই শিক্ষার্থী।
এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মো. আল-আমিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলায়। তার চতুর্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলমান। ১৭ আগস্ট ছিল প্রথম পরীক্ষা। ৪০২ নম্বর কোর্সের পরীক্ষা ছিল ২২ আগস্ট, যাতে তিনি অংশ নিতে পারেননি। রোববার (২৮ আগস্ট) তার ৪০৩ নম্বর কোর্সের পরীক্ষা আছে। তাতেও অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয়ে আছেন আল-আমিন।
কুরিয়ারের মাধ্যমে চিঠি পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। তিনি বলেন, কুরিয়ারের মাধ্যমে একটি অভিযোগ এসেছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
লিখিত অভিযোগে আল-আমিন বলেন, মার্কেটিং বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ শশী ও তাকি আহমেদের সঙ্গে কয়েক মাস ফ্রিল্যান্সিং ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’-এর কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু মনোমালিন্য হওয়ায় বছরখানেক আগে তিনি কাজ ছেড়ে দেন। এ কাজের জন্য তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্র ছিল না। এরপর গত ১৭ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টায় পরীক্ষা শেষে বের হওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা তাকে রবীন্দ্রভবন থেকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩৩১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ ওরফে শশী, তাকি আহমেদসহ অনেকে আসেন।
আল-আমিন উল্লেখ করেছেন, কিছুক্ষণ পর মুমিনুর রহমানের সঙ্গে আসা লোকজন তাকে প্রচুর মারধর করেন। মুমিনুর তার মাথায় দুই লিটার পানির বোতল ও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। তিনি একপর্যায়ে অচেতন হয়ে যান। এ সময় তার মোবাইল থেকে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেন তারা। জ্ঞান ফেরার পর রাত ৮টার দিকে জোর করে তার ডেবিট কার্ড নিয়ে গিয়ে ৪৫ হাজার টাকা তোলেন সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও ভাস্কর সাহা।
একপর্যায়ে মুমিনুর ও তার অনুসারীরা তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এতে মৃত্যুভয়ে আতংকিত হয়ে পড়েন আল-আমিন। তারা জোর করে মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেন এবং সেটির ভিডিও ধারণ করেন। তারা হুমকি দিয়ে বলেন, তাদের কথার বিপক্ষে কোনো কথা বললে এবং কোনো পদক্ষেপ নিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তাই তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য তারা যা বলেছেন, তাই করেছেন।
আল-আমিন অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, তাকে ভয় দেখিয়ে স্ট্যাম্প পেপারে সই নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু তার বোন জরুরি নম্বরে (৯৯৯) কল করার পর পুলিশ আসায় সই নিতে পারেননি। এরপর রাত ৯টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সে রাতেই জীবন বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে শরীয়তপুরে চলে যান তিনি। এখনো তাকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী।
আল-আমিন বলেন, তাদের কাছে তার পরীক্ষার প্রবেশপত্র আছে। তিনি ভয়ে আছেন। রাজশাহীতে আসতে পারছেন না। এ কারণে তিনি কুরিয়ারের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠিয়েছেন। এ ঘটনার বিচার চান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুমিনুর রহমান বলেন, আল-আমিনসহ আরও কয়েকজনকে তাদের দুরবস্থার সময় তিনি চাকরি দিয়েছিলেন। এক-দেড় বছর চাকরি করার পর আল-আমিন বলেন, তিনি বিসিএস পরীক্ষা দেবেন। পরে তিনি চলে যান। কিন্তু তারা কয়েকজন গিয়ে আরেকটি কোম্পানি খোলেন। সেখানে তার কোম্পানির ক্লায়েন্টদের নিচ্ছেন তারা। এতে তার ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ নিয়ে তারা ১৭ আগস্ট বিষয়টির সুরাহার জন্য কথা বলতে বসেছিলেন তারা। তাকে কেউই মারধর করেননি।
৪৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মুমিনুর রহমান বলেন, সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও ভাস্কর সাহা আলোচনার সময় ছিলেন। কিন্তু পরে কী হয়েছে, এটা বলতে পারবেন না তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্তকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা বলেন, তিনিসহ অনেকেই ওইদিন আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন। মুমিনুর ও আল-আমিনের মধ্যে ব্যবসায়িক একটি বিষয় ছিল। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগটি মিথ্যা। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে বলেও জানান তিনি।।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। এ অভিযোগ পুরোটাই মিথ্যা তথ্যে সাজানো। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আজ সকালে জানতে পেরেছি। এরই মধ্যে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দোষীরা কোনোভাবে ছাড় পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী আতংক বা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে এইটা আমরা চাই না এবং এটা হতে দিতে পারি না।’