টানা প্রায় ৯ মাস ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত চলছে। চলমান এই সংঘাতে সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিষয়েও দেশটি নীরব।
এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আরও একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। অবশ্য পদত্যাগের কারণ ব্যক্তিগত বলে জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার (২২ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় আট মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধে ৩৭ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চলতি সপ্তাহে পদত্যাগ করেছেন বলে মার্কিন মিডিয়া জানিয়েছে।
পদত্যাগকৃত ওই কর্মকর্তার নাম অ্যান্ড্রু মিলার। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন। অ্যান্ড্রু মিলার তার চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তের জন্য ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করেছেন বলে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা গত শুক্রবার জানিয়েছে।
মিলার তার সহকর্মীদের বলেন, তিনি তার পরিবারের সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে চান। কারণ গত বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়া বর্তমান যুদ্ধ ‘সবচেয়ে বেশি সময় গ্রাসকারী’ হয়ে উঠেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েল সরকারের প্রতি ‘শক্তিশালী এবং রুক্ষ সমর্থনের’ বিষয়ে তিনি সংশয়বাদী ছিলেন বলেও ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে। মূলত মার্কিন প্রভাবশালী এই সংবাদমাধ্যমই প্রথম মিলারের পদত্যাগের খবর সামনে আনে।
দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস ধরে ইসরায়েল গাজায় আগ্রাসন চালাচ্ছে। আগ্রাসন চালানোর পাশাপাশি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। এমন অবস্থায় জাতিসংঘ এবং সাহায্য গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে গাজাজুড়ে সাহায্য পৌঁছাতে এবং বিতরণে বিভিন্ন ধরনের বাধার অভিযোগ করে আসছে।
গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ৩৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডজুড়ে মানবিক সংকট গ্রাস করেছে। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সমালোচকরা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য এবং ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসনের পক্ষাবলম্বনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করছেন।
আর ইসরায়েলের প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত সমর্থন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থাজুড়ে একের পর এক কর্মকর্তার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে এবং এর মধ্যে সর্বশেষ পদত্যাগ করলেন মিলার।
ওয়াশিংটন পোস্ট আরও বলেছে, মিলার তার সহকর্মীদের বলেছিলেন- যদি তার ব্যক্তিগত দায়িত্বের জন্য চাকরি ছাড়তে না হতো, তবে তিনি তার চাকরিতে থাকতেই পছন্দ করতেন।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আল জাজিরার কিম্বার্লি হ্যালকেট বলেছেন, একের পর এক পদত্যাগ গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে প্রেসিডেন্টের জোরালো সমর্থনের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশার কথাই তুলে ধরেছে।
হ্যালকেট বলেছেন, ‘ইতোমধ্যে, বেশ কয়েকজন হাই-প্রোফাইল কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন, তারা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট (জো বাইডেন) কিছু ক্ষেত্রে সত্যকে বিকৃত করছেন বা এমনকি গাজায় বিপুল প্রাণহানির বিষয়েও চোখ বন্ধ রাখছেন।’
আরেক মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, সদ্য পদত্যাগ করা মিলার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশ জারিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর সেই আদেশে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের ওপর হামলার জন্য বেশ কিছু ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
অ্যান্ড্রু মিলার পূর্বে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একজন সিনিয়র নীতি উপদেষ্টা ছিলেন এবং ওবামা প্রশাসনে হোয়াইট হাউস জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে মিসর ও ইসরায়েল সামরিক বিষয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর আগে গত মে মাসে বাইডেনের ইসরায়েল নীতির প্রতিবাদে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। তার নাম স্টেসি গিলবার্ট। তিনি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব পপুলেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড মাইগ্রেশনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। তিনি কংগ্রেসে জমা দেওয়া বাইডেন প্রশাসনের ওই রিপোর্টে কাজ করা একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
এর আগে মে মাসের মাঝামাঝিতে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিবাদে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের আরও একজন কর্মী প্রকাশ্যে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকৃত ওই কর্মকর্তার নাম লিলি গ্রিনবার্গ কল।
তিনি মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের চিফ অব স্টাফের বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্বপালন করছিলেন। লিলি গ্রিনবার্গ কল তার পদত্যাগ পত্রে লিখেছেন, তিনি ‘তার বিবেক ও বিচারবুদ্ধিকে সাথে নিয়ে এই প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করা চালিয়ে যেতে পারেন না’।
অবশ্য লিলি গ্রিনবার্গ কল নিজেও একজন ইহুদি এবং গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেসব মন্তব্য করেছেন তারও নিন্দা করেন তিনি।
এর আগে ওই একই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনা কর্মকর্তা গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে ওয়াশিংটনের সমর্থনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকৃত ওই সেনা কর্মকর্তার নাম হ্যারিসন মান। তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা ছিলেন।
নভেম্বরে তিনি ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ) থেকে পদত্যাগ করেন। হ্যারিসন মান তার পদত্যাগের চিঠি নিজের লিঙ্কডইনে প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রায় অকুণ্ঠ ও নিঃশর্ত সমর্থন হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও অনাহারে রাখতে ভূমিকা রেখেছে।’
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের গাজা নীতির বিরোধিতা করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরবি ভাষার মুখপাত্র হালা রাহারিত পদত্যাগ করেন। সেসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিঙ্কডইনে দেওয়া এক পোস্টে এ তথ্য নিজেই নিশ্চিত করেন তিনি।
লিঙ্কডইন পোস্টে তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মানজনক পদে ১৮ বছর চাকরি করার পর ২০২৪ সালের এপ্রিলে আমি পদত্যাগ করেছে। গাজা ইস্যুতে মার্কিন সরকারের নীতিই এর কারণ।’
এছাড়া গত মার্চ মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার কর্মকর্তা অ্যানেল শেলিন। মধ্যপ্রাচ্যের এই বিশ্লেষক মার্কিন সরকারের পক্ষে মানবাধিকার বিষয়ে প্রচারের পাশাপাশি এই সংক্রান্ত দায়িত্বও পালন করতেন।
শেলিনের পদত্যাগের আগে গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরেক কর্মকর্তা জশ পল পদত্যাগ করেন। বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করা ওই কর্মকর্তা ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোর একজন পরিচালক।
এছাড়া একই কারণে গত জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন মার্কিন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা তারিক হাবাশ। জ্যেষ্ঠ এই মার্কিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নীতি উন্নয়নের অফিসের বিশেষ সহকারী পদে ছিলেন।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলের দূতাবাসের বাইরে গাজায় আগ্রাসনের প্রতিবাদে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেন মার্কিন বিমানকর্মী অ্যারন বুশনেল। পরে তিনি মারা যান।