মোঃ মনিরুল ইসলাম বিপিএম-বার, পিপিএম-বার : পুলিশে যোগদানের পর প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে। পুলিশের ইতিহাস পড়তে এবং পড়াতে গিয়ে দেখেছি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক বর্তমান পুলিশের গোড়া পত্তনের পর প্রথমবার পুলিশ জনতার কাতারে দাঁড়ায় ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়।
যিনি যেভাবেই মূল্যায়ণ করুন না কেন, কোন উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই একটা শৃঙ্খলা বাহিনীর সাধারণ সদস্যরা নিজেদের সিদ্ধান্তে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে- তাঁদের কত বড় বুকের পাটা তার মূল্যায়ন হয়তো সম্ভব হবে না। বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকেই তখন তাঁরা সরকারী আদেশ হিসেবে নিয়েছিলেন।
বাস্তববাদী বলেই আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন যে, মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘসময় পুলিশের গৌরব করার মত তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। ব্যক্তিগত ভাবে অনেক পুলিশ সদস্য নন্দিত হলেও সামষ্টিকভাবে পুলিশ অনেকক্ষেত্রেই নিন্দিত ভূমিকা পালন করেছে। ইতোপুর্বে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হলেও সামগ্রিকভাবে পুলিশকে গণমুখী পেশাদার পুলিশ হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগের ঘাটতিই পরিলক্ষিত হয়।
তবে বিগত দশকে পুলিশকে পেশাদার বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা বেশ কিছুটা এগুলেও শতবছরে গড়ে ওঠা Subculture যেমন, মানুষের সাথে দূর্ব্যবহার, জনহয়রানী, দুর্নীতি, অদক্ষতা, স্বচ্ছতার অভাব, ব্যবহৃত হওয়ার অভ্যাস ইত্যাদি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। একটা বড় অংশের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও কোন কোন সদস্যের হঠাৎ অপকর্ম পুরো বাহিনীকেই জাতির সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছি যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনমুখী পেশাদার পুলিশ বাহিনী গড়ার যে কার্যক্রমগুলি চালু হয়েছিল তা একটা অনবদ্য গতি পেয়েছে এই বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে দেশের এই মহাসংকটে। একাত্তরের পুলিশের কথা শুনেছি কিন্তু করোনাকালের পুলিশের সদস্য হিসেবে আমি দেখতে পারছি, এ এক অন্য রকম পুলিশ, জনতার পুলিশ। কি তার কাজ আর কি তার কাজ নয় সেটি বিবেচনা মূখ্য নয়, বরং যেখানে যখন যা প্রয়োজন দেখছে, পুলিশ তা-ই করছে। আইন-শৃংখলা রক্ষার পাশাপাশি, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন কিংবা ঘরে থাকা বাস্তবায়ন, সামাজিক দূরত্ব প্রতিপালন নিশ্চিতের প্রচেষ্টা, নিজস্ব অর্থায়ন এবং সমাজের দয়াবান মানুষদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে ও গোপনে ত্রাণ পৌঁছানো, আটকেপড়া মানুষের ঘরে বাজার পৌঁছে দেওয়া, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে হাসপাতালে পাঠানো, অবিবেচক ভাড়াটিয়া কিংবা প্রতিবেশীদের কবল থেকে চিকিৎসাকর্মী ও করোনা রোগীকে পরিত্রান দেওয়া, এমনকি করোনাতে মৃত্যু কিংবা করোনা সন্দেহে মৃতদেহের সৎকার- কোথায় নেই পুলিশ। পুলিশের সেই দূর্বীনিত, ঔদ্ধত্যপূর্ন চেহারার পরিবর্তে এক মানবিক অবয়বের পুলিশ। মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর যে সংস্কৃতি পুলিশের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মনে হয় এরকম পুলিশই চেয়েছিলেন, দেশের সাধারন মানুষ ও বোধহয় এমন পুলিশই দেখতে চায়।
করোনা যুদ্ধে যারা সৈনিক তাদের আত্মোৎসর্গের মাধ্যমেই এই যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব, যেমনটি হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে এক নম্বর সেক্টর-হাসপাতালে লড়ছেন চিকিৎসাকর্মী, কিন্তু হাসপাতালের বাইরে অনেকগুলো সেক্টরে লড়ছে পুলিশ। দু’পক্ষকেই মূল্য ও দিতে হয়েছে এবং হবে অনেক বেশী। ইতোমধ্যেই আমার চার সহকর্মী করোনা লড়াইয়ে শহীদ, তাঁদের আত্মদান আমাদের যেমন ব্যথিত ও মর্মাহত করে ঠিক তেমনি গৌরবে বুকের ছাতি ফুলিয়ে দেয়। আমার অনেক সহকর্মী ইতোমধ্যে এই লড়াইয়ে শামিল হয়ে আহত অর্থাৎ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। সহকর্মীদের মৃত্যু ও আক্রান্তের খবরে আমরা থমকে যাই কিন্তু তা আমাদের দায়িত্বপালন থামাতে পারে না, পারবে না কখনোই। বড় ধরনের বাস্তব ঝুঁকি আছে জেনেও আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই এবং দাঁড়াবো।
চিকিৎসাকর্মী ও পুলিশ ছাড়াও করোনা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে লড়ছে প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আনসার বাহিনীসহ নানা সরকারী বেসরকারী সংস্থা। পুলিশের মতই নানা সেক্টরে লড়ছেন সংবাদকর্মীরাও আত্মদানের তালিকায় তাঁরাও আছেন। আমি করোনা যুদ্ধে শহীদ সকলের আত্মার শান্তি কামনা করি, আরোগ্য কামনা করছি, যাঁরা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনাযুদ্ধে নাজেহাল ইংল্যান্ডের সরকারী কর্তৃপক্ষের ব্রিফিং এ তিনটি শব্দগুচ্ছ দেখি, Stay Home, Protect NHS, Save Lives. অনুপ্রানিত হয়ে আমিও বলি, আপনারাই বাঁচাতে পারেন চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক কিংবা করোনাযুদ্ধে প্রথম সারিতে যুদ্ধরত সৈনিকদের। কেননা, আপনাদের বাঁচাতেই তাঁরা হাসপাতালে ও বাইরে পরিশ্রম করে আক্রান্ত ও জীবন উৎসর্গ করছেন।
বৈশ্বিক ও জাতীয় তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে আমি বিশ্বাস করি যে করোনা মহাযুদ্ধে মানবজাতির জয়লাভের সময় ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে। নজিরবিহীন দ্রুতগতিতে ভ্যাকসিনের পরীক্ষণমূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, অনেক দেশেই করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট ওষুধের পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলছে। করোনা যুদ্ধে যারা টিকে থাকবে তারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে “করোনা” নামক ঠান্ডা জ্বরে সমগ্র মানব জাতির নাকানি চুবানী খাওয়ার গল্প শোনাবে। কিন্তু যতদিন ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধের সফলতার সুখবর না আসে ততদিন আপনারা দয়া করে-
- ঘরে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন ;
- প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পড়ুন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন ;
- সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান ;
- WHO এবং IEDCR প্রদত্ত পরামর্শ মেনে চলুন ;
- সতর্ক থাকুন, নিজে বাঁচুন, পরিবার ও মানুষ বাঁচান।
আপনি এগুলো মেনে চললেই আমাদের কাজটা কমবে, আমাদের ঝুঁকি কমে যাবে।
বিশ্বাস রাখুন, “ আমরা করবো জয় একদিন!”
(ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত )
লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।