বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ২ কোটির কাছাকাছি। এই রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর কিডনি বিকল হয় ৪০ হাজারের এবং তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই মারা যায় ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনের চিকিৎসার অভাবে। এমনকি চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশিরভাগ রোগী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয়। এছাড়া হঠাৎ করে কিডনি বিকল হয়েও দেশে বছরে আরো ২০ হাজার রোগী মারা যায়।
গতকাল শনিবার রাজধানীতে শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী কিডনি ফাউন্ডেশনের ১৮তম বার্ষিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিডনি রোগ ও প্রতিস্থাপনবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, যথাসময়ে কিডনি রোগ শনাক্তের জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করা জরুরি। মরণোত্তর অঙ্গদান বা ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিষয়ে লোকজনকে আরো উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মৃত ব্যক্তির কিডনি দান করা হলে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচবে।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, একজন ব্যক্তিকে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করার পর তার কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা লিভার, অগ্ন্যাশয় ও খাদ্যনালি এই অঙ্গগুলো অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। আর কার্ডিয়াক ডেথ বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির চোখের কর্নিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। এসব অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট বলা হয়।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ও ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে কিডনি রোগ ও কিডনি অকেজো রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দুটো কিডনি অকেজো হয়ে গেলে রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন করতে হয়। বাংলাদেশে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
এই চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তবে কিছু সরকারি হাসপাতাল এবং কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালসহ বেসরকারি পর্যায়ে কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে স্বল্পমূল্যে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মরণোত্তর কিডনি দান করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। সুতরাং এই ধরনের সেবা অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করলে মানুষের উপকার হবে।
এ সময় কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ বলেন, কিডনি রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য জেলা পর্যায়ে ডায়ালাইসিস করার ব্যবস্থা রাখা এবং প্রতিটি মেডিকেল কলেজে কিডনি সংযোজনের ব্যবস্থা রাখা দরকার। এর সঙ্গে সঙ্গে কিডনি রোগবিশেষজ্ঞ, ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগবিশেষজ্ঞ ও নার্সদের উচ্চতর ট্রেনিং বিশেষভাবে প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, কিডনি রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। আর্থিক সংকটে বেশিরভাগ কিডনি রোগী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। মৃত ব্যক্তির অঙ্গদানের বিষয়ে অনেক মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। সেসব দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মৃত্যুর পর অঙ্গদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্রেন ডেথ ঘোষিত ব্যক্তির কিডনি দানের বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারে ধর্মীয় নেতাদের যুক্ত করতে হবে।
কিডনি জটিলতা এড়াতে যথাসময়ে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তের পরামর্শ দেন বিএসএমএমইউর সহ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, কিডনি রোগের প্রধান কারণ হচ্ছে ডায়াবেটিক এবং উচ্চ রক্তচাপ। নিয়মিত স্ক্রিনিং না করানোর কারণে দেশে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যথাসময়ে শনাক্ত হয় না। এ কারণে কিডনি সমস্যাও যথাসময়ে শনাক্ত না হয়ে কিডনি রোগী বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গত ৩০ বছর থেকে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন করে আসছে। আমরা কিডনি ও লিভার সংযোজন নিকট আত্মীয়ের জীবিত অবস্থায় শুরু করেছি এবং মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-সংযোজন করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে সহকর্মীদের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকার ওপর জোর দেন যুক্তরাজ্যের রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালের চিকিৎসক মুহাম্মদ মাগদি ইয়াকুব। তিনি বলেন, একে অপরের কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। চিকিৎসাসেবায় শুধু চিকিৎসকরাই যুক্ত থাকেন না, নার্স প্যারামেডিক থেকে শুরু করে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরও ভূমিকা রয়েছে।
সূচনা বক্তব্যে কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন রুবেল বলেন, দেশে প্রতিবছর ৪০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হয়। সময়মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করায় অনেকে একদম শেষ সময়ে এসে জানতে পারেন যে, তাদের কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, বর্তমানে ৩০০ বেডের এই কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে প্রতিদিন ২০০-২৫০ রোগী ডায়ালাইসিস করে থাকে এবং এরই মধ্যে ৬৫০ জনের বেশি কিডনি সংযোজন সাফল্যজনকভাবে করা হয়েছে। রোগী নিজের বাসায় ডায়ালাইসিস (সি.এ.পি.ডি) করে থাকে। এছাড়াও এই হাসপাতালে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি রয়েছে। যেখানে ৫০ শতাংশ কম খরচে সবধরনের পরীক্ষা করা যায়। এ ছাড়াও প্রতিদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মাত্র ৪০০-৫০০ টাকায় রোগী দেখে থাকেন। রোগী বিনা বেড ভাড়ায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে পারে।