“বডি শেমিং ” এক ধরনের মানসিক টর্চার

“বডি শেমিং ” আপনি,আমি, আমরা প্রতিনিয়ত এই বডি শেমিং এর স্বীকার হচ্ছি। আর যাদের দ্বারা হচ্ছি তারা আর কেউ নয় এই আপনি, আমি, আমরাই। আপনি হচ্ছেন আমার দ্বারা আমি হচ্ছি আপনার দ্বারা। পার্থক্য টা হলো আপনি যখন আমাকে বডি শেমিং করছেন তখন আমার কাছে মনে হয় এটা “বডি শেমিং” কিন্তু আমি যখন আপনাকে করছি তখন সেটা আর বডি শেমিং মনে হয়না।

এখন অনেকের মনে প্রশ্ন বডি শেমিং টা আসলে কি বা সমস্যাটা কোথায়? সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনি যদি কারো দেহের আকার, আয়তন বা ওজন নিয়ে প্রকাশ্যে এমন কোনাে সমালােচনা বা মন্তব্য করেন যাতে সেই মানুষটি লজ্জাবােধ বা অপমানিতবোধ করেন তবে তা বডি শেমিং। আমরা মানুষ আর আল্লাহ একেক মানুষকে এককভাবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মধ্যে কেউ কালো হবে, কেউ শ্যামলা হবে আবার কেউ সুন্দর হবে এটা হচ্ছে মানুষের রূপের ধর্ম আর এটাই আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য। আল্লাহ মানুষকে তার মতো করে মনের মাধুরি মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং একেক জনের মধ্যে একক রকম রূপ- গুণ দিয়েছেন। মানুষ মানেই বৈচিত্র্যময় কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে মানুষের সেই বৈচিত্র্য মেনে নিতে পারিনা।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আমাদের সাথে যখন কারো দেখা হয় আমরা বুঝে হোক আর না বুঝেই আমরা সর্বপ্রথম এই বডি শেমিং দিয়ে আলোচনা শুরু করি। যেমন- কিরে বন্ধু কি অবস্থা তর? তুইতো অনেক শুকিয়ে গেছিছ, তর চোখের নিচে এমন কালি পড়লো গেছে, তর অল্প বয়সে চুল পেকে যাচ্ছে, তর কণ্ঠ এমন মুরগি বাচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছে, তর মুখের এই অবস্থা কেন?
মেয়েদের ক্ষেত্রে – তুমার মুখে এমন কালো দাগ পড়লো কিভাবে? তুমার চুলগুলো এতো খাটো কেন? মেয়েদের চুল এতো খাটো ভালো দেখায় না। তুমি এমন চিকন হলে কিভাবে? হরিণের বাচ্চার মতো হয়েগেছো। এখনো সময় আছে পুষ্টিকর খাবার খাও। মেয়েরা এতো চিকন কেমন দেখায়..!
তুমার শরীর বেড়ে যাচ্ছে, ডায়েট করো। পরে কিন্তু বিয়ের সময় প্রস্তাতে হবে, আমার পাশের বাসার কলিগের মেয়ের শুধুমাত্র এই মোটা হওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত বিয়ে হয়নি।

এছাড়াও তিরস্কারমূলক বিভিন্ন নামতো আছেই ওজন বেশি হলে ‘মােটকু’, শীর্ণকায় হলে চিকনা’ বেশি লম্বা হলে ‘লম্বু’ ইত্যাদি শব্দবাণে জর্জরিত হতে হয়। গায়ের রং নিয়ে নারী-পুরুষ সবাইকে বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। অনেক সময় কেউ নিছক মজার জন্য এমন করেন, কেউ আবার না বুঝেই এমন মন্তব্য করে ফেলেন, যেটা অপরের জন্য মনােকষ্টের কারণ হয়।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, গড়ে ৪৫ শতাংশ
কিশাের-কিশােরী জীবনে কখনাে না কখনাে বডি শেমিংয়ের মুখােমুখি হয়েছে।

বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি যেন আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে বডি শেমিং এর মাত্রা। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ যখন একটি ছবি পোস্ট করে সেখানেও তাকে হতে হয় বডি শেমিং এর স্বীকার। কমেন্ট বক্সে শারীরিক গঠন নিয়ে থাকে নেগেটিভ কথার ছাড়া-ছড়ি। অনেকেই এই মানসিক টর্চার থেকে মুক্তির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪২ লাখের বেশি লােক প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজেদের গড়ন পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই বডি শেমিংয়ের কারণে। কেউ কেউ বডি শেমিংয়ের কারণে সামাজিক যােগাযােগমাধ্যম বা ইন্টারনেট দেখে
নিজের গড়ন পরিবর্তন করার জন্য অপ্রতিষ্ঠিত, টোটকা বিকল্প ডায়েট গ্রহণ করে নিজের জীবনকেও বিপন্ন করে ফেলেন।

আমরা যখন কারো শারীরিক গঠন নিয়ে এধরণের প্রশ্ন করি বা তিরস্কার মূলক কথা বলি তখন সেই ব্যক্তি নিশ্চুপ থাকে অথবা হাসিমুখে কিছু একটা বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন যদি আপনি কখনো এরকম প্রশ্ন আর উপদেশের সম্মুখীন হন এটা কতটা বিব্রতকর, কতটা কষ্টের, কতটা মানসিক চাপ ফেলে। আপনি হয়তো ভাবছেন আমিতো তার ভালোর জন্যই বলছি, আমিতো তার খারাপ চাইনা। কিন্তু আদোও কি তার জন্য এটা ভালো কিছু বয়ে আনে? গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষ বডি শেমিং এর ফলে একধরনের মানসিক চাপ অনুভব করে। যার ফলে নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, হীনমন্যতা কাজ করে, শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

তাই যা বলে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করতে যাচ্ছেন তা যদি তার জন্য ভালো না হয় বরং কষ্টের কারণ হয় তাহলে না বলাই ভালো। এতো কঠিন ভালোকিছু না করে এমন অনেক কাজ আছে যা খুব সহজে আপনি করতে পারেন যা আপনার জন্য, মানুষের জন্য এবং জাতির জন্য মঙ্গল সেগুলো করুন।
নিজে ভালো থাকুন এবং অন্যকে ভালো থাকার সুযোগ করে দিন।

ইমরান হোসাইন,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন...