আলহাজ্ব মুফতী মুহাম্মদ খোরশেদ আলম: আল্লাহ তায়ালা মানব সম্প্রদায়কে এ দুনিয়াতে তাঁরই ইবাদত-বন্দেগীর জন্য পাঠিয়েছেন। এ মানব সম্প্রদায় এখানে কিছুদিনের মেহমান। স্বীয় সুযোগ ও নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এখান থেকে আসন্ন আগামী সফরে সে যাত্রা করবে। ভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর স্মরণে স্বীয় সময় কাটায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রতিক্ষণে অস্থির থাকে। যার প্রতিটি আমলই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরীকায় হয়ে থাকে। যার প্রতিটি কাজ পূতঃপবিত্র শরীয়ত মোতাবেক হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তি দুনিয়াতেও সফলকাম এবং আখেরাতেও সফলকাম। মাহে রমজান সফলকাম হওয়ার উত্তম সময়। এ মাসে রোজা ফরজ করা হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যশীল ও সফলকাম করে।
রোজা আল্লাহর খুবই প্রিয় ইবাদত। তাই শুধু রোজা নয়, রোজার সংশ্লিষ্ট বিষয়েরও অনেক ফজীলত রয়েছে। যেমন ভোরবেলা সাহরী খাওয়া। আমরা যাকে ‘সেহরী’ বলে জানি, মূলত তার সঠিক উচ্চারণ ‘সাহরী’। পরিভাষায় সাহরী ঐ খানাকে বলা হয় যা সুবহে সাদিকের কিছু পূর্বে খাওয়া হয়। সাহরীতে অনেক বরকত রয়েছে। অল্প পরিমাণ হলেও সাহরী খাওয়া সুন্নাত। পেট ভরে খাওয়া জরুরী নয়, এক ঢোক পানি পান করলেও এর সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাহরী খাও। কেননা, সাহরীতে বরকত রয়েছে। (মুসলিম)
অন্য এক হাদীসে আছে, সাহরী খাওয়া বরকতপূর্ণ কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহরী কর। কারণ যারা সাহরী খায় আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দুআ করেন।
সাহরী রোজাদারের প্রয়োজনেই খাওয়া হয়। অথচ আল্লাহ তায়ালা কত বড় মেহেরবান যে, সাহরী খাওয়াকেও বান্দার জন্য সওয়াবের কারণ বানিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই অলসতার দরুণ এই বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমাদের এবং আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হল সাহরী না খাওয়ার মধ্যে। অর্থাৎ তারা সাহরী খায় না, আমরা খাই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেস রা. নামক জনৈক সাহাবী বলেন, আমি একবার রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে এমন সময় হাজির হলাম, যখন তিনি সাহরী খাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, এটি একটি বরকতের জিনিস যা আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে দান করেছেন। এটাকে কখনোই ছাড়বে না।
সুবহে সাদিকের কাছাকাছি সময় সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা মাকরূহ যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সকল নবীকে (সময় হয়ে গেলে দেরি না করে) তাড়াতাড়ি ইফতার করতে আদেশ করা হয়েছে এবং সাহরী বিলম্বে খেতে বলা হয়েছে।
আমর ইবনে মায়মুন আলআওদী বলেন, সাহাবায়ে কেরাম দ্রুত ইফতার করতেন আর বিলম্বে সাহরী খেতেন।
সাহরী সংক্রান্ত কিছু মাসয়ালা
* সাহরী খাওয়া অনেক ফজীলত ও বরকতের আমল। তাই ক্ষুধা না লাগলে বা খেতে ইচ্ছে না করলেও সাহরীর ফজীলত অর্জন করার নিয়তে কিছু পানাহার করা উচিত। কিছু না হলেও একটু পানি পান করলেও এই ফজীলত ও বরকত পাওয়া যাবে। * নিদ্রার কারণে সাহরী খেতে না পারলেও না খেয়েই রোজা রাখতে হবে। ‘সাহরী খাওয়া হয়নি’ – এই অজুহাতে রোজা না রাখা অত্যন্ত পাপ। * বিলম্বে সাহরী খাওয়া উত্তম। আগে খাওয়া হয়ে গেলেও শেষ সময় নাগাদ কিছু চা-পানি ইত্যাদি পানাহার করতে থাকলেও বিলম্বে সাহরী করার ফজীলত অর্জিত হবে। * সাহরীর সময় আছে বা নেই নিয়ে সন্দেহ হলে সাহরী না খাওয়া উচিত। * কেউ সাহরীর সময় আছে মনে করে পানাহার করল অথচ পরে জানা গেল যে, তখন সাহরীর সময় ছিল না, তাহলে রোজা হবে না; তবে সারাদিন তাকে রোজাদারের ন্যায় থাকতে হবে এবং রমজানের পর ঐ দিনের রোজা কাজা করতে হবে। * শেষ রাতে সাহরী খাওয়ার পর যদি কেউ পান খায়, তবে সুবহে সাদিকের পূর্বেই উত্তমরূপে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। উত্তমরূপে কুলি করার পরও যদি সকালে থুথুতে কিছু লাল দেখায়, তবে তাতে রোজা ভঙ্গ হবে না। * যদি কেউ সাহরী খেয়ে পান মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে ঘুমিয়ে পড়ে এবং পান মুখে থাকা অবস্থাতেই রাত ভোর হয়ে যায়, তবে তার রোজা শুদ্ধ হবে না। এই রোজা ভাঙ্গতে পারবে না। তা সত্ত্বেও এর পরিবর্তে একটি রোজা কাজা রাখতে হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে সঠিক আমলের মাধ্যমে রমজানের সকল বরকত ও ফজীলত অর্জনের তাওফীক দান করুন।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, দারুল উলুম কাকরাইল, রমনা, ঢাকা
পিবিএ/এএম