বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র রাজনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে

আলী রিয়াজ : ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১৯ সালে এক শিক্ষার্থীর খুন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের নিয়োগ দেয়া প্রশাসনে দুর্নীতির মতো বিষয়ে বিস্তৃত অসন্তুষ্টি দমিয়ে রাখতে পেরেছে তারা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ২০১৮ সালের নির্বাচনকে প্রহসনিক হিসেবে বর্ণনা করেছে। নির্বাচনটিতে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজিরবিহীন জয় লাভ করে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরেছেন। একইসঙ্গে এই নির্বাচন, নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা ভেঙ্গে দিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিম্ন ভোটার উপস্থিতি তার নিদর্শন। নির্বাচনটি দেশের রাজনৈতিক পথও ঠিক করে দিয়েছে- গণতন্ত্র থেক দূরে, কর্তৃত্ববাদের দিকে।

ক্ষমতাসীনদের এজেন্ডার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তুলতে বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর কৌশলগত ঘাটতি ছিল। নেতৃত্ব নিয়ে তাদের সিদ্ধান্তহীনতা ও দুর্বল সাংগঠনিক সক্ষমতা এতে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। জামায়াতে ইসলামীর (জেই) সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তাদের আলোচনার অক্ষমতা এ সমস্যাকে আরো তরান্বিত করেছে।
জামাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বিএনপির ওপর চাপ রয়েছে।

যদিও দলটির অনেক নেতা মনে করেন এতে তারা ভোট হারাবে। লন্ডনে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নেতৃত্বও দলের অভ্যন্তরে মতবিরোধ বাড়িয়েছে। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী সাংসদদের, কার্যত একদলীয় সংসদের যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির দুর্বলতা ফুটিয়ে তুলেছে। পাশাপাশি একদলীয় পার্লামেন্টটিকে আরো বৈধতা এনে দিয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আদালত তার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি এখনো জেলবন্দি।

শক্তিশালী বিরোধীদলের অনুপস্থিতি, পার্লামেন্টের অনবধানতাজনিত ভুল ধরার ঘাটতি ও জবদিহিতা না দেয়ার ব্যবস্থা নির্বাহীদের ক্ষমতার অপব্যবহারকে জোরদার করেছে। ক্ষমতাসীনদের কর্মীদের মধ্যে দায়মুক্তিতার সংস্কৃত বিরাজ করছে। এর কর্মীরা চাঁদাবাজি, নির্যাতন ও অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত। গত অক্টোবরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হাতে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের খুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতষ্ঠানগুলোয় তাদের বিস্তৃত চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের চর্চাকে সবার সামনে তুলে এনেছে।
গত সেপ্টেম্বরে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ক্ষমতাসীন দলের যুবনেতাদের চাঁদাবাজি চক্রের দৌরাত্ম প্রকাশ পেয়েছে। এই অভিজান, প্রাথমিকভাবে ‘শুদ্ধি অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। পরবর্তীতে তা ‘দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান’ হিসেবে পরিচিত পায়। কিন্তু এতে চুনোপুটিরা বেরিয়ে আসলেও পালের গোদারা ঠিকই অস্পৃশ্য রয়ে গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, এ ঘরানার শাসন চলতে থাকলে ফেটে যেতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বুদবুদ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে ও এখানে ব্যবসা করার পরিস্থিতি আরো সাবলীল হয়েছে। তা সত্ত্বেও এসব উদ্বেগজনক উপসর্গ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অনুসারে, বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মুখে আছে ও বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাত, পুজি বাজার ও অর্থ পরিশোধের ভারসাম্য তীব্র সমস্যার সম্মুখীন। এমতাবস্থায় সিপিডির এ মূল্যায়ন দুঃসংবাদ। কমতে শুরু করেছে রপ্তানির হার। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস, তৈরি পোশাকশিল্প নিম্নমুখে ধাবিত হচ্ছে। চাকরি হারাচ্ছে এ খাতের হাজারো কর্মী। বিভিন্ন তথ্যানুসারে, প্রধান অর্থনৈতিক নির্দেশকগুলো নিম্নমুখী আভাস দিচ্ছে। দেশ অর্থনৈতিক মন্দার দিকে এগুচ্ছে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর কিছু ঘটনা দুটি প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের অপরাধ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিদের নজর কেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, আসামে ভারতের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধীকরণ বা নাগরিকপঞ্জিও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে নিপীড়নের ভয়ে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে ঢুকছে হাজারো মানুষ। ভারতের প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশি সরকারের ভরসা, স্বাধীন অবস্থান নেয়ায় সরকারের অনিচ্ছার প্রতিফলন। বাংলাদেসের ভেতরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ভারতের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি বাড়ছে। ভারতের আচমকা পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য এখানে প্রকট আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ভারত-বিরোধী মতবাদ আরো জোরদার হয়েছে। হাসিনাও গত অক্টোবরে নয়া দিল্লি সফরে এ বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের জের ধরে দেশটিতে দুই মন্ত্রীর সফর বাতিল করেছে বাংলাদেশ। যোগ দেয়নি যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকেও। দুই দেশের মধ্যকার অসম সম্পর্ক বিবেচনায়, হাসিনা সরকার কোনো শক্ত অবস্থান নিতে পারবে কিনা তা এখনো অস্পষ্ট।

২০১৯ সালের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনাচক্র ২০২০ সালের জন্য সম্ভাব্য দিক নির্দেশনা তৈরি করে দিয়েছে। দেশের জিডিপি বৃদ্ধি ও বিশাল, দৃশ্যমান অবকাঠামো প্রকল্পের ক্রেডিট নিজেদের দাবি করেছে সরকার। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্য যখন প্রশ্নবিদ্ধ, আয় সমতা যখন দ্রুত হারে বাড়ছে ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নের লক্ষণ যখন আরো স্পষ্ট হয়েচ উঠছে, তখন প্রশ্ন থেকে যায়- সরকার এসব বিষয় কিভাবে সামাল দেবে?

দেশজুড়ে অসন্তুষ্টি বাড়ছে। অন্যদিকে বলপ্রয়োগের এপর সরকারের নির্ভরতাও বাড়ছে। এমতাবস্থায় সরকার দেশ পরিচালনায় আরো কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কমিয়ে দেয়ার আশঙ্কা বেশি। বিরোধীদলগুলো নতুন পথে ধাবমান না হলে ভবিষ্যতে আরো দমনের সম্মুখীন হবে। পাল্টা ধাক্কা না দিলে গণমাধ্যম প্রতিধ্বনির কামরায় পরিণত হবে। অব্যাখ্যেয় রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার গতিপথ পাল্টানো গেলে তবেই এই হতাশাপীড়িত দৃশ্যের পরিবর্তন আসবে।

(ইস্ট এশিয়া ফোরাম থেকে অনূদিত। মূল প্রতিবেদনটির লেখক আলী রিয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিকস অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বিভাগের একজন অধ্যাপক।)

পিবিএ/জেডআই

আরও পড়ুন...