‘বাংলাদেশ-চীন দুই দেশেরই শান্তিপূর্ণ মিয়ানমার প্রয়োজন’

একটি শান্তিপূর্ণ মিয়ানমার যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি চীনেরও প্রয়োজন বলে মনে করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সব অংশের প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য চীনকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবিক অর্থে চীনের খুব বেশি পদক্ষেপ নেই।

‘দ্য রোহিঙ্গা ইন বাংলাদেশ: ইন সার্চ অব আ সাসটেইনেবল ফিউচার’ (বাংলাদেশে রোহিঙ্গা: টেকসই ভবিষ্যতের সন্ধানে) শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারের সমাপনী অধিবেশনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ কথা বলেন।

সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ওই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ফরেন সার্ভিস একাডেমি ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস) ওই সেমিনারের আয়োজন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ও সিজিএসের পরিচালক অধ্যাপক এ এস এম আলী আশরাফের সঞ্চালনায় ওই অধিবেশনে সমাপনী বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।

রোহিঙ্গা সংকটে চীনের ভূমিকা নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই চীন সমস্যার সমাধানে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এটি তাদের তাত্ত্বিক অবস্থান। তবে বাস্তবিক অর্থে খুব বেশি পদক্ষেপ তাদের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। মিয়ানমারে গভীর স্বার্থ রয়েছে চীনের। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমার চীন সফরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন যে তাঁরা সংকট সমাধানে চেষ্টা করবেন।’

বাংলাদেশে মিয়ানমার মানে রাখাইন; কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তের বেশির ভাগ অংশই রাখাইনের সঙ্গে—এ কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এখন রাখাইন অঞ্চল আরাকান আর্মির দখলে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সব অংশের প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য চীনকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। একটি শান্তিপূর্ণ মিয়ানমার যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি চীনেরও প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা বোঝাতে গিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার এমন একটি দেশ, যার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা অনুবিভাগ রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কাজ করার জন্য উপদেষ্টা মর্যাদার একজন হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের একটিই সমাধান। সেটি হচ্ছে প্রত্যাবাসন। তবে প্রত্যাবাসন হতে হবে তারা যেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে, সে স্থানে অধিকার, নিরাপত্তাসহ ফিরে যাওয়া। অন্য স্থানে তাদের পুনর্বাসন করলে হবে না। আর এ সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা প্রয়োজন। তাদের নিশ্চিত করতে হবে, রোহিঙ্গাদের ওপর যাতে একই ধরনের নৃশংসতা আর কখনোই না হয়।

বর্তমানে মিয়ানমারে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি চলছে, তা রোহিঙ্গাদের জন্য সুখবর নিয়ে আসতে পারে অনুমান করে তৌহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো সংকট সমাধানের একটি সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে পারবে। তবে এটি নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ শেষ হলে দেশটি আগের অবস্থায় ফেরত যেতে পারবে না। ফলে সেখানে একটি পরিবর্তন আসবে।

সংকট সমাধানে আসিয়ান সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা নিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, আসিয়ানের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আসিয়ান সংগঠনের আইন অনুযায়ী, এক দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে কিছু বিষয় রয়েছে, যা আর অভ্যন্তরীণ থাকে না। যেমন রোহিঙ্গা সংকট এখন আর অভ্যন্তরীণ নেই, এটি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকেও আক্রান্ত করেছে। রোহিঙ্গারা নৌকায় করে ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চলে গেছে। আসিয়ান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। রোহিঙ্গা নিয়ে অনেক দেশ কথা বলছে না, তবে কিছু দেশ জোরোলোভাবে কথা বলছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ওপর আরও বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, বিশ্বের অনেকেই একে অন্যের দেখাদেখি সহায়তা কমিয়ে আনছে। যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে অবস্থান নিয়েছে, তা পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে পারে। তিনি বলেন, ‘আশা করি, রোহিঙ্গাদের জন্য তারা অর্থসহায়তা বন্ধ করবে না। রোহিঙ্গা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটি হয়তো এ মুহূর্তে আমাদের সীমানার মধ্যে রয়েছে। তবে এ বিষয়টিতে এখনই মনোযোগ না দিলে এটি শুধু আর বাংলাদেশের সংকট থাকবে না।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বলতে গিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের চাহিদা ও সরবরাহ অব্যাহত রাখা। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহযোগিতা কমিয়ে আনছে। তিনি বলেন, ‘তবে এটিও বলে রাখতে চাই যে রোহিঙ্গাদের আমরা একীভূত করব না।’

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি প্রত্যাবাসনের পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপে (রূপরেখা) জোর দিতে চাই। কারণ, প্রথমে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে গিয়ে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে পারে যে আমরা সংকট সমাধানের পথে রয়েছি। এরপর হয়তো তারা আর রোহিঙ্গাদের নিল না। ফলে পাইলট প্রকল্পে স্বল্পভাবে যাওয়া শুরু করল, তবে প্রত্যাবাসনের সম্পূর্ণ পথনকশা থাকতে হবে।’

আরও পড়ুন...